মতিঝিলের এসিল্যান্ড আবিদের ভয়ংকর রেট চার্ট ফাঁস, ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার খেলা সরকারি কাগজে!
- আপডেট: ০৮:০৪:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
- / ১৮০০৯
মোঃ মনিরুজ্জামান মনির :
মতিঝিল রাজস্ব সার্কেল আজ এক ভয়াবহ ঘুষ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সরকারি সেবার নামে চলছে টাকার লেনদেন, ভয়, আর চাঁদাবাজির বাণিজ্য। আর এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ রেফাঈ আবিদ যিনি প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বানিয়েছেন ব্যক্তিগত আয়ের অস্ত্র। তিনি যোগদানের পর থেকেই পুরো অফিসে যেন দুর্নীতির অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। ঘুষ ছাড়া এক ইঞ্চিও এগোয় না কোনো ফাইল। সেবা নয়, এখন মতিঝিল ভূমি অফিসে বিক্রি হয় কেবল “আবিদের আশীর্বাদ”।
সূত্র জানায়, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এই ঘুষখোর এসিল্যান্ড তৈরি করেছেন এক ভীতিকর ঘুষের রেট তালিকা যেখানে প্রতিটি কাজের নির্দিষ্ট ঘুষ নির্ধারিত। ‘খ’ তফসিলের ফাইলের জন্য দিতে হয় ৩০,০০০ টাকা যার মধ্যে আবিদের ভাগ ১৪,০০০ টাকা। “পার্ট এলএ” ও “পার্ট খাস” জমির ফাইলের জন্য দিতে হয় ১৬,০০০ টাকা এর মধ্যে ৭,০০০ টাকা সরাসরি যায় আবিদের হাতে। সাধারণ নামজারির জন্য ঘুষ ৮,৫০০ টাকা কিন্তু ১০ শতকের বেশি জমি হলে ঘুষ দ্বিগুণ। এমনকি ছোটখাটো আবেদনেও ন্যূনতম ঘুষ ৫,০০০ টাকা, যার মধ্যে এসিল্যান্ড নেন ২,০০০ টাকা তা-ও মাত্র ১০ শতক জমির জন্য। ১০ শতকের ওপরে হলে তার ভাগ বেড়ে যায় দ্বিগুণ হারে।
এতেও শেষ নয় শ্যামপুর এলাকার শিল্প প্লটের জন্য কেবল আবিদকেই দিতে হয় ২০,০০০ টাকা। কোনো মিসকেসের ফাইল উঠলেই ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সরকারি ফি যাই হোক, আবিদের ঘুষই চূড়ান্ত। আর এই ভয়ংকর ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ লুকাতে তিনি ব্যবহার করেন “বিশেষ চিহ্ন ব্যবস্থা” যে কাগজে সেই চিহ্ন নেই তা সরাসরি নামঞ্জুর করে দেন। ফলে ঘুষ না দিলে আবেদনই বাতিল হয়ে যায়। জানা যায় যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ রেফাঈ আবিদ এর চাহিত ঘুষের পরিমান কম হওয়ায় নামজারি কেস নং ৪৮৩৮, ও ৪২৮৮, ২৫/২৬ এই দুইটা কেস অজানা কারনে আটকে রেখেছে এই ঘুষখোর এসিল্যান্ড।
এই দুর্নীতির রাজত্বে কাজ করে এক বিশাল দালাল বাহিনী যারা প্রতিদিন শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে দেয় এই ঘুষখোর এসিল্যান্ডের হাতে। কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে চলে জুলুম আর ভয় দেখানো। জনগণের সেবার জন্য খোলা সরকারি দরজা এখন সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের প্রতীক। কোনো সাধারণ নাগরিক নামজারির আবেদন করলে তাকে ঘুরতে হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ যদি না নির্ধারিত ঘুষের টাকা পরিশোধ করা হয়।
এক ভুক্তভোগী বলেন, “এই অফিসে নামজারি করতে গেলে ঘুষ না দিলে ফাইল হারিয়ে যায়, আবার টাকা দিলেই একদিনে কাজ হয়ে যায়। সরকারি সেবা এখন টাকার খেলা। আরেকজন বলেন, “সব কাগজ ঠিক ছিল, কিন্তু ঘুষ না দেয়ায় আমার আবেদন নামঞ্জুর করেছে। পরে টাকা দিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ফাইল পাস হয়। এটা কেমন বিচার?
অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালনা করেন আবিদ নিজে। তিনি অফিসের ভেতরে নির্দিষ্ট ঘরে বসে নির্দেশ দেন কার ফাইল পাস হবে, কারটা ঝুলিয়ে রাখতে হবে। রাতে দালালদের আনাগোনা চলে বাইরে থেকে অফিস বন্ধ মনে হলেও ভেতরে চলে টাকার বানিজ্য। সরকারি সময় শেষ হলেও রাত ১০টা পর্যন্ত থাকে অদ্ভুত এক ব্যস্ততা যেখানে সরকারি কাগজ নয় টাকার বান্ডিলই ঘুরে বেড়ায়।
এই ঘুষের সাম্রাজ্যের মূল অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছে আবিদের নিজস্ব দল। তার পোষ্য সন্ত্রাসী কিরণ এবং নোয়াখালীর হাসান নামের দালাল নিয়মিতভাবে সাধারণ মানুষ ও ভূমি সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে নেয়। তারা অফিসের ভেতরে এবং বাইরে উভয় জায়গায় “ঘুষ কালেকশন পয়েন্ট” তৈরি করেছে। প্রতিদিন শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তা পৌঁছে দেয় এসিল্যান্ডের টেবিলে। এছাড়া এই অফিসের শাসন ও ঘুষের টাকার লেনদেনের সার্বিক তদারকি করেন আবিদের বিশেষ বিশ্বস্ত লোক অফিস সহকারী রাকিব। তিনিই নিশ্চিত করেন প্রতিটি ঘুষের টাকা সময়মতো উপরে পৌঁছে যায়। রাকিবকে ঘিরে অফিসে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ংকর আতঙ্ক তার অনুমতি ছাড়া কেউ ফাইল ছুঁতেও পারে না।
অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুরিয়ে রাখা হয় যেন কোনো প্রমাণ দেখা না যায়। তদন্তে জানা গেছে, ক্যামেরা সচল থাকলে আবিদের নির্দেশেই তার দিক পরিবর্তন করা হয়। ফলে এই দুর্নীতির অন্ধকারে আলোর দেখা পাওয়া দুরূহ। এই ঘুষখোর এসিল্যান্ড এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যেখানে আইন, নীতি বা প্রশাসনিক নিয়ম তার কাছে কিছুই নয়। “আবিদ যা বলেন, তাই চূড়ান্ত” এই নীতি এখন অফিসের অঘোষিত আইন। কর্মচারীরা তার নির্দেশ ছাড়া নড়াচড়া করে না। ঘুষের অর্থ প্রতিদিন তার টেবিলে জমা হয় হিসাবের খাতায়। সরকারি দায়িত্বের পরিবর্তে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অঘোষিত কালোবাজার, যেখানে জনগণের কষ্টই তার লাভের পুঁজি। জনগণের দুর্ভোগ এখন সীমাহীন। কেউ জমির নামজারি, রেকর্ড বা কাগজ সংশোধনের জন্য এ অফিসে গেলে তাকে টেবিল থেকে টেবিল ঘুরতে হয়, শুনতে হয় অজুহাত আর অবমাননাকর কথা। সেবার নামে চলছে শোষণ যেখানে ঘুষই একমাত্র সমাধান।
সচেতন নাগরিক সমাজ বলছে, সৈয়দ রেফাঈ আবিদ শুধু একজন দুর্নীতিবাজ নয় তিনি এক ভয়ংকর প্রশাসনিক দানব, যিনি সরকারি ব্যবস্থার ভেতরেই তৈরি করেছেন ঘুষের সাম্রাজ্য। তার বিরুদ্ধে এখনই তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা না হলে মতিঝিল ভূমি অফিস পরিণত হবে প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রতীকে।
সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তবে এই অন্ধকার রাজত্ব ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে আর জনগণ চিরতরে হারাবে তাদের ন্যায্য সেবার অধিকার। সৈয়দ রেফাঈ আবিদ আজ মতিঝিলের জনসাধারণের দুঃস্বপ্ন একজন ঘুষখোর এসিল্যান্ড যিনি অফিস নয়, চালাচ্ছেন এক ঘুষের সাম্রাজ্য।




















