সোশ্যাল মিডিয়ার গোপন গ্রুপে ভয়ংকর মাদক এমডিএমবি কারবার,চক্রের মূলহোতাসহ গ্রেফতার ৫
- আপডেট: ০২:১৭:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
- / ১৮০০৮
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ভ্যাপ ও ই–সিগারেটের আড়ালে ভয়ংকর মাদক এমডিএমবি দেশের তরুণ সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছিল একটি সুগঠিত চক্র। দীর্ঘদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ার গোপন গ্রুপ ও এনক্রিপটেড চ্যাট ব্যবহার করে “অদৃশ্য বাজার” তৈরি করা এই নেটওয়ার্কের মূলহোতাসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
গ্রেফতারকৃতরা হলো-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত ছাত্র খন্দকার তৌকিরুল কবির তামিম,মেহেদী হাসান রাকিব,একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেলস এবং মার্কেটিং কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত মো.মাসুম মাসফিকুর রহমান ওরফে সাহস,সম্প্রতি ইন্ডিয়াতে পড়াশোনা করে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা মো.আশরাফুল ইসলাম।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে এসব জানান ডিএনসির মহাপরিচালক মো.হাসান মারুফ।
তিনি বলেন,সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে তরুণ সমাজের মধ্যে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপস এর ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ই-সিগারেট ও ভ্যাপস এর অভ্যন্তরে নিকোটিন বা টোবাকো জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হতো,যাতে আইনানুগ কোনো বাধা নেই। কিন্তু সম্প্রতি ই-সিগারেট ও ভ্যাপস এর ভেতরে নিউ সাইকোঅ্যাকটিভ সাবস্ট্যান্স (এনপিএস),অপিওডসসহ বিভিন্ন ধরণের বিপদজনক সাবস্ট্যান্স এর ব্যবহার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল নার্কোটিক কন্ট্রোল বোর্ড (আইএনসিবি) কর্তৃক অপারেশন ই-ভেপোর-এইট নামে বিশ্বব্যাপী একটি ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং প্রোগ্রাম শুরু করা হয়।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও উল্লিখিত মাদকের বিস্তার রোধে নজরদারিতে নামে ডিএনসি ঢাকা গোয়েন্দার একটি চৌকস টিম যাদের তৎপরতায় উন্মোচিত হয় ভয়ংকর মাদক এমডিএমবি ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব চিত্র।
অনলাইন-ডার্ক ওয়েবে নজরদারি নতুন মাদক শনাক্ত:
ঢাকার গোয়েন্দা টিম অফলাইন ও অনলাইন মার্কেটপ্লেস, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডার্ক ওয়েবে নজরদারি শুরু করে। এ সময় ভ্যাপ-এর মাধ্যমে গোপনে ছড়িয়ে পড়া এক নতুন ধরনের মাদক এমডিএমবি এর সন্ধান পাওয়া যায় এবং খুচরা বিক্রেতা হিসেবে তামিমকে চিহ্নিত করা হয়। একই সঙ্গে সোর্স ব্যবহার করে তার কাছ থেকে স্যাম্পল অর্ডার করা হয়।
অর্ডারকৃত সেই মাদক ডেলিভারির মুহূর্তে ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে, ঢাকা মেট্রো উত্তর ও দক্ষিণের একটি সমন্বিত টিম গত বুধবার মিরপুর পল্লবীতে ২০ মিলি এমডিএমবিসহ সরবরাহকারী তামিমকে গ্রেফতার করা হয়।
তামিমকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বিশ্লেষণ করে এই ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট আসামি মেহেদী হাসান রাকিবের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে গোয়েন্দা নজরদারি ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকার মিরপুর এলাকা হতে ১০ মিলি এমডিএমবি সহ তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিএনসি জানায়,আসামি রাকিবের জবানবন্দিতে উদ্ঘাটিত হয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা একটি এমডিএমবি-সাপ্লাই নেটওয়ার্ক। সেই সাথে শনাক্ত করা হয় মালয়েশিয়া থেকে দেশে এমডিএমবি আনার মূলহোতা আশরাফ ও সাহস। পরবর্তীতে অভিযানে চক্রের দুই প্রধানকে গ্রেফতার করে তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালালে উদ্ধার হয় ৩১০ মিলিলিটারের ৫ কন্টেইনার এমডিএমবি পিনাকাসহ উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যগুলো।
মিরপুর সেনপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়,দীর্ঘদিন যাবত সমাজের এলিট শ্রেণীর মাঝে সে এই ধরনের মাদক সরবরাহ করত। সে মূলত ই-সিগারেট ও ভ্যাপস এর ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে তার সহযোগী সাহসের সমন্বয়ে এমডিএমবি মাদকের একটি মার্কেট তৈরির প্রচেষ্টা করছিল। বিভিন্ন সময় মালয়শিয়ায় যাতায়াত করায় সেখান থেকে সে এই মাদক সংগ্রহ করে দেশে সরবরাহ করত।
এমডিএমবি বিক্রয়ের কৌশল:
চক্রটি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে পুরোপুরি “অদৃশ্য বাজার” হিসেবে ব্যবহার করত। ফেসবুক-এর ক্লোজড গ্রুপ, রিভিউ পেজ ও ভুয়া অ্যাকাউন্টে গোপন সংকেতভিত্তিক পোস্ট দিত তারা। যেখানে সাধারণ ফ্লেভার, গেমিং টুল বা “পোর্টেবল ডিভাইস”-এর আড়ালে বোঝানো হতো আসল পণ্য। আগ্রহী ক্রেতা ইনবক্সে মেসেজ পাঠালে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো ইন্ড-টু-ইন্ড এনক্রিপটেড হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে। যেখানে কোডওয়ার্ডে দাম ঠিক করা হতো। অবস্থান শেয়ার, লাইভ ট্র্যাকিং এবং নির্দিষ্ট ইমোজি ব্যবহার করে সরবরাহ নিশ্চিত করা হতো। যা দেখে সাধারণ ব্যবহারকারী বুঝতেই পারত না যে এটি আসলে ভয়ংকর এই মাদকের গোপন ডিজিটাল বিক্রয় নেটওয়ার্ক। সোশ্যাল মিডিয়ার আড়ালে এমন দক্ষভাবে তারা মাদক বেচাকেনা করত যে পুরো লেনদেনটাই থাকত “নিরাপদ, দ্রুত এবং অদৃশ্য তাদের ভাষায়, “অনলি ফর ট্রাস্টেড ভ্যেপার্স” এই সকল হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ পর্যালোচনা করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরও একাধিক ব্যক্তি ডিএনসির গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে।
এমডিএমবি এর ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে ডিএনসি ডিজি বলেন,ভ্যাপ ও ই-সিগারেট কার্টিজের ভেতরে গোপনে মেশানো শুরু হয়েছে ভয়ংকর তরল সিনথেটিক এই মাদক।
যা কয়েক ফোঁটাই মানুষের স্নায়ুতন্ত্র বিপর্যস্ত করতে সক্ষম। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ভ্যাপ ডিভাইসকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে এই মাদক দ্রুত নেশা ধরায়,হ্যালুসিনেশন, আক্রমণাত্মক আচরণ থেকে শুরু করে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হওয়ার মতো মারাত্মক শারীরিক ঝুঁকি তৈরি করে।





















