স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির হোতা মিঠু গ্রেফতার

- আপডেট: ১২:৩২:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৮০০৪
নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেট করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে জড়িত বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গ্রেফতারের তথ্য নিশ্চিত করেন।
সংবাদমাধ্যমে পাঠানো ক্ষুদেবার্তায় তিনি বলেন,আওয়ামী সরকারের আমলে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির হোতা মোতাজ্জরুল ইসলাম মিঠুকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি)।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে,গ্রেফতারকৃত আসামিকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
মিঠুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্প্রতি মামলা করেছে দুদক।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান,প্রাথমিক অনুসন্ধানে মিঠুর বিরুদ্ধে কৃষি জমি ক্রয়,জমি লিজ,প্লট, ফ্ল্যাট এবং বাড়ি নির্মাণে বিনিয়োগসহ ১৮ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া তার বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ার/বিনিয়োগ,গাড়ি ক্রয়, বিভিন্ন ব্যাংক স্থিতি,স্বর্ণালংকার, আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীসহ মোট ৫৭ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ২৩৮ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদসহ সর্বমোট ৭৫ কোটি ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ৭৩৮ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।
করোনাকালীন দেশে স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি সামনে আসার পর তাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। মামলা- গ্রেফতার বাঁচতে ২০২০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান বিতর্কিত এই ঠিকাদার। কিন্তু ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশটিতে থাকা মিঠুর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। সে সময় দেশে ফিরে প্রথমে গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামে গা ঢাকা দেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝে এর কিছুদিন পর ঢাকায় এসে স্বাস্থ্য খাতে ফের আধিপত্য বিস্তারের পাঁয়তারা শুরু করেন। এ নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও আমলার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর দুদক তৎপর হয়ে ওঠে। সংস্থাটির আবেদনের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে মিঠুর সম্পদ জব্দ ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে তখন আত্মগোপনে চলে যান মিঠু। গুঞ্জন ওঠে—তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিগন্যালে গোপনে দেশ ছেড়ে পালান মিঠু। এরপর কয়েক বছর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। পরিস্থিতি বুঝে সম্প্রতি মিঠু দেশে ফেরেন। এরপর রংপুরে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং চলতি মাসের শুরু থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
দুদক সূত্র জানায়,অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইস ও টেকনোক্রেট নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক মিঠু কৃষি জমি ক্রয়,জমি লিজ, প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি নির্মাণে মোট ১৮ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ার ও বিনিয়োগ, গাড়ি ক্রয়,ব্যাংক হিসাবের স্থিতি, স্বর্ণালংকার,আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী মিলিয়ে মিঠুর আরও ৫৭ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ২৩৮ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ৭৩৮ টাকা। এ ছাড়া মোতাজ্জেরুল ইসলামের নামে পারিবারিক ব্যয়ের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৭১ কোটি ৪৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৪ টাকা। অর্থাৎ পারিবারিক ব্যয়সহ তার মোট সম্পদ ও ব্যয়ের হিসাব দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ ৪৬ হাজার ১৭২ টাকা। ব্যবসা,বাড়িভাড়া,কৃষি আয়,বেতন-ভাতা,ফার্মের অংশ,ব্যাংক সুদ,নিরাপত্তা জামানতের সুদ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স থেকে মোতাজ্জেরুল ইসলামের বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া গেছে ৭১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৫ টাকা। ফলে দেখা যায়, তিনি জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে প্রায় ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভোগদখল করেছেন।
এর আগে ২০১৬ সালের ১০ মে বনানী থানায় দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক মিঠুর বিরুদ্ধে একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেন। তবে ওই মামলায় এখনো চার্জশিট দিতে পারেনি দুদক। ২০২০ সালে দুদকের সুপারিশের পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হয়নি মিঠুর কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই তালিকায় ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমে ২০২০ সালের ১ জুলাই মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ‘অতীব জরুরি তলবি নোটিশ’ পাঠায় দুদক। তবে, মিঠু হাজির না হয়ে সেখানেও দুদককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তারা জানিয়েছেন,দুদক মিঠুকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ভালো খবর আসতে পারে।
তবে শুধু দুদকের অনুসন্ধানেই নয়,মিঠুর অপকর্মের ফিরিস্তি উঠে এসেছে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেপারসেও।