উচ্ছেদ অভিযানও এখন বেচাকেনার পণ্য, রাজউক কর্মকর্তা মামুনের টেলিফোনেই বদলায় সিদ্ধান্ত
- আপডেট: ০৮:৫০:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০২২
মোঃ মনিরুজ্জামান মনির:
রাজউক জোন-৩/২ এর সহকারী অথরাইজড অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন আজ রাজধানীর প্রশাসনিক দুর্নীতির এক ভয়ংকর প্রতীক হয়ে উঠেছেন এবং অভিযোগ রয়েছে, তিনি ঘুষ ও ভয়ভীতির একক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন যা মিরপুর, বনানী, গুলশান থেকে শুরু করে সাভারের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। মামুন এখন রাজউকের ভেতর এক ধরনের “দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড” হিসেবে পরিচিত যিনি নিয়মনীতি, আইন এবং সরকারি আদেশের তোয়াক্কা না করে টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভবন নির্মাণ, অনুমোদন পরিবর্তন এবং উচ্ছেদ রোধে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে চলেছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন জোন-৩/২ মূলত মহাখালী অফিস থেকে পরিচালিত হয় যেখানে মিরপুর, বনানী ও গুলশানের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা অন্তর্ভুক্ত। এখানেই গড়ে উঠেছে মামুনের সিন্ডিকেট, যেটি ভবন অনুমোদন থেকে শুরু করে মাসিক চাঁদাবাজি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে ঘুষকে নিয়মে পরিণত করেছে। জনা যায় মিরপুর সেকশন ১-এর ব্লক-জি, রোড-৫, প্লট-৫ এ বেজমেন্টসহ ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন না থাকলেও মামুনের প্রত্যক্ষ অনুমোদনে ভূমি মালিক মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে অবৈধভাবে ভবন গড়ে তুলেছেন। একইভাবে মিরপুর সেকশন-১ এর ব্লক-জি, রোড-৩, প্লট-১৫-এ সেটব্যাক পরিবর্তন করে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী ৫০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও মাত্র ২৫ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে এখানেও মামুনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনুমোদন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে এবং অভিযোগ রয়েছে তিনি ওই ভবনের মালিকের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার উৎকোচ নিয়েছেন। এছাড়া মিরপুর সেকশন-২ এর ব্লক-ডি, প্লট-৭৬ এ কোনো নকশা অনুমোদন ছাড়াই চারতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে সেখানে স্বপ্ন সুপার শপ ও একাধিক রেস্টুরেন্ট স্থাপন করা হয়। এই ভবনের অনুমোদন না থাকলেও মামুন ও তার সিন্ডিকেট প্রায় ২০ লাখ টাকা এককালীন ঘুষ গ্রহণ করেন এবং নিয়মিত মাসোহারা হিসেবে টাকা নিতে থাকেন। নাছিম টাওয়ার নামে মিরপুর সেকশন-১ ব্লক-জি রোড-১ এর একটি অবৈধ চারতলা ভবন উচ্ছেদের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও মামুন বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন এবং ওই ভবন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ সংগ্রহ অব্যাহত রাখেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন মিরপুর সেকশন-১ ব্লক-ই চিড়িয়াখানা রোডের ৪০ ও ৪১ নম্বর প্লটে অনুমোদনবিহীন চারতলা বানিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে রেস্তোরা ও শপিংমল ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মামুন এই অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেননি বরং মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করে বিষয়টি আড়াল করে রেখেছেন। আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি তার সিন্ডিকেটভুক্ত ইমারত পরিদর্শকদের দিয়ে নির্মাণাধীন ভবন মালিকদের অফিসে ডেকে এনে ভবন ভেঙে ফেলা বা বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বন্ধ করার ভয় দেখিয়ে মাসিক লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করেন। এভাবে রাজধানীর ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকাগুলো এখন মামুনের দুর্নীতির পকেটস্থ রাজ্যে পরিণত হয়েছে যেখানে আইন কেবল অর্থের বিনিময়ে কাজ করে। রাজউকের জোন-৩/২ এর মূল অথরাইজড অফিসার শেগুপ্তা শারমিন আশরাফ যখন বিদেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ও পারিবারিক কারণে দায়িত্বে অনুপস্থিত ছিলেন, সেই সুযোগে মামুন পুরো এলাকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন। তিনি অধস্তন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজউকের নাম ব্যবহার করে কোটি টাকার অবৈধ ভবনকে বৈধতার সনদ দেন এবং যারা ঘুষ দিতে অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ নোটিশ জারি করেন। স্থানীয় সূত্র বলছে, মামুনের হাতে এখন এক ধরনের “অঘোষিত অনুমোদন ব্যবসা” চলছে। রাজউকের ফাইলের প্রতিটি অনুমোদনের পেছনে নির্দিষ্ট হারে ঘুষ নির্ধারিত ছোট ভবনের জন্য দেড় লাখ, মাঝারি ভবনের জন্য দুই লাখ এবং বড় প্রকল্পের জন্য তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। ভবনের প্ল্যান পাস না হলে কিংবা ভবন ভাঙার নোটিশ ঠেকাতে চাইলে ঘুষের পরিমাণ আরও বাড়ে। মামুনের রাজনৈতিক আশ্রয় ও উচ্চ পর্যায়ের প্রভাবের বিষয়ে স্থানীয়দের মধ্যে জোর গুঞ্জন রয়েছে; বলা হচ্ছে তিনি আ.লীগ আমলে রাজনৈতিক সুপারিশে রাজউকে যোগদান করেন এবং দ্রুতপদোন্নতি পেয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিয়েছেন। মিরপুর, গুলশান ও বনানীর মতো এলাকায় বেশ কিছু নামকরা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান মামুনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা ভবনের নকশা ও উচ্চতা বাড়ানোর অনুমোদন পেতে মামুনকে মাসিক ভাতা দেয়। এমনকি রাজউকের উচ্ছেদ অভিযানকেও তিনি ঘুষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন—যে ভবনে টাকা আসে, সেই ভবন টিকে থাকে; যে ভবনের মালিক টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ বা মামলা। এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় মামুন তৈরি করেছেন কয়েকজন “দালাল অফিসার” যারা রাজউকের নামে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভবন মালিকদের ভয় দেখায়। তাদের কৌশল হলো, প্রথমে ছবি তুলে রিপোর্ট দেওয়ার হুমকি, পরে মামলা বা উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে ঘুষের দরদাম ঠিক করা। রাজধানীর এই দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে মামুন ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক প্রভাব। নড়াইল জেলার বেড়ামারা গ্রামের এই ব্যক্তি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্যের সুপারিশে ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর রাজউকে প্রধান ইমারত পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। এরপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অথরাইজড অফিসার হন। দায়িত্বের শুরু থেকেই তিনি দুর্নীতিকে নিয়মে পরিণত করেন। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হলেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগকারীদের বদলি করে দেওয়া হয়, আর যারা চুপ থাকে তারা তার সিন্ডিকেটে স্থান পায়। রাজউকের অভ্যন্তরে এখন একটা অঘোষিত গুজব—“মামুনকে না মানলে ফাইল আটকে যাবে।
ঢাকায় রাজউকের কার্যক্রমের সিংহভাগ এখন মামুনের হাতের মুঠোয়। মিরপুরের ব্লকজুড়ে যে অবৈধ ভবনগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রত্যেকটির পেছনে মামুনের অনুমোদনের ছায়া রয়েছে। এমনকি সরকারি জমিতেও তিনি চোখ বুজে ভবন উঠতে দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন বা রাজউক উচ্ছেদ টিম যখন অভিযান পরিচালনা করতে যায়, তখন মামুনের টেলিফোন নির্দেশেই অনেক সময় সেই অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। অভিযুক্ত ভবনগুলো থেকে তিনি এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা নেন এবং প্রতি মাসে মাসোহারা গ্রহণ করেন। রাজউকের সূত্র অনুযায়ী, মামুনের নামে থাকা সম্পদ তার সরকারি বেতনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। রাজধানী ও নিজ এলাকায় একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট, প্রাইভেট কার ও পারিবারিক বাড়ির মালিক তিনি। তার ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যায় বিপুল অঙ্কের নগদ লেনদেন, যার কোনোটিরই আইনগত উৎস নেই। তবুও রাজউক কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। ধারণা করা হয়, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবের কারণেই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকার মিরপুর ও আশপাশের এলাকাবাসীর অভিযোগ, মামুন এখন প্রশাসনিক সন্ত্রাসের রূপ নিয়েছেন। রাজউকের নামে ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় এখন তার নিয়মিত কাজ। কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে তার দালালরা হাজির হয়ে যায়; তারা বলে রাজউকের অনুমতি নেই, তাই জরিমানা লাগবে। এরপর শুরু হয় ঘুষের দরকষাকষি। কেউ টাকা না দিলে তাদের নামে মামলা বা নোটিশ পাঠানো হয়। ফলে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে রাজউকের নাম শুনলেই আতঙ্কিত হয়। একাধিক মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় নেতারা বলেছেন, “আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকায় ঘুষ বাণিজ্যে সবচেয়ে দক্ষ কর্মকর্তা। তিনি আইন জানেন, দুর্বল জায়গা বোঝেন এবং সেটিকেই ব্যবহার করেন নিজের সুবিধায়। তারা আরও বলেন, যতদিন রাজউক এই ধরনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেবে, ততদিন নগর উন্নয়নের নামে দুর্নীতি চলতেই থাকবে। রাজধানীর নাগরিক সমাজ বলছে, মামুনের মতো কর্মকর্তারা রাজউকের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে এখন উন্নয়ন নয়, চলছে কমিশনের বাণিজ্য। রাজউকের জোন-৩/২ এলাকায় ভবন অনুমোদন মানেই ঘুষের নির্দিষ্ট হার, আর সেই ঘুষের মাস্টারমাইন্ড হলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও স্থায়ী অপসারণের দাবি উঠেছে প্রতিটি স্তরে। কারণ, যদি এখনই এই দুর্নীতির চক্র ভাঙা না হয়, তাহলে রাজধানীর নির্মাণ খাত পুরোপুরি ঘুষ নির্ভর হয়ে পড়বে আর প্রশাসনের ভেতর এমন দক্ষ দুর্নীতিবাজদের হাতে নগর পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাবে।




















