ক্যান্টনমেন্ট রাজস্ব সার্কেল গিলে খাচ্ছে আসিফ-নাজিম-শিপন সলিমুল্লাহ গং

- আপডেট: ০৭:১৩:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৫
- / ১৮০৪২
বিশেষ প্রতিনিধি:
রাজধানীর খিলক্ষেতস্থ ক্যান্টনমেন্ট রাজস্ব সার্কেল এসিল্যান্ড অফিস যেন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভয়ারণ্য। প্রতিদিন এখানে ভুক্তভোগীরা জমির মালিকানা প্রমাণ, নামজারি, জমাভাগ, খতিয়ান কিংবা খারিজের জন্য আসেন। কিন্তু দালাল ও অফিসকর্মচারীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে তারা ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ছাড়া এ অফিসে কোনো কাজ হয় না। অফিস সহকারী-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সালাউদ্দিন নাজিম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আসিফ, অফিস সহায়ক মোহাম্মদ শিপন মিয়া, সার্ভেয়ার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই ঘুষের রাজত্ব। তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে নাজির ছলিমুল্লাহ, বহিরাগত দালাল মামুদ, সাইফুল, সবুজ, অপু যারা নিজেদের পরিচয় দেয় “ওমেদার” হিসেবে কিন্তু আসলে তারা স্থানীয় কুখ্যাত ভূমিদস্যু।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অফিসের কানুনগো ও এসিল্যান্ড পর্যন্ত তাদের কব্জায় চলে গেছে। এমনকি যারা সেবা নিতে আসেন তারাও জিম্মি হয়ে পড়েন এই চক্রের কাছে। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নামজারি কেস, জমাভাগ, মিসকেস, রিট কেস সব কিছুর জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুষ না দিলে ফাইলই নড়ে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের নির্ধারিত রেট অনুযায়ী জেনারেল কেসে ১০ হাজার, এলএ-৩৮ কেসে ৪০ হাজার, খ তালিকায় ৬০ হাজার, ১/১ খতিয়ানে ৮০ হাজার, আসিয়ান রিট নজরুলের নামে ২ লাখ এবং এপি (অর্পিত) কেসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জমির পরিমাণ বেশি হলে ঘুষের অঙ্কও বেড়ে যায়। একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, শুধু ফাইল সচল রাখতে প্রথমে দিতে হয় অগ্রিম টাকা, তারপর প্রতিটি ধাপে ধাপে দিতে হয় আলাদা ঘুষ।
এক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, তিনি নিজের পৈত্রিক জমির নামজারি করতে গিয়ে প্রথমে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দেন। তবুও তার কেস বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় দলিলের একটি শব্দ ভুল লেখা। পরে আবার তাকে জানানো হয় নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে ফাইলটি পুনরায় সচল করা হবে। শেষ পর্যন্ত ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার পর সেই একই দলিল ও কাগজপত্র দিয়েই তার নামজারি অনুমোদন করা হয়। অর্থাৎ শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল ভুক্তভোগীকে জিম্মি করে ঘুষ আদায় করা।
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো ডিসিআর ফি নিয়ে প্রতারণা। সরকার নির্ধারিত ডিসিআর ফি ১১৫০ টাকা হলেও অফিসে সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা। কিন্তু ক’দিন পর ভুক্তভোগীকে জানানো হয় তার কেস বাতিল হয়ে গেছে কারণ ডিসিআর ফি সময়মতো জমা দেওয়া হয়নি। অথচ টাকা নেওয়া হয়েছে নিয়মমাফিক। এর ফলে একই কেসে বারবার ঘুষ দিতে হচ্ছে মানুষকে।
এই অফিসের চারপাশ দালালদের নিয়ন্ত্রণে। বহিরাগত মাহমুদ নিজেকে ঢাকার ডিসির ভাই পরিচয় দিয়ে অফিসে দাপট দেখান। আসলে তিনি বহিরাগত দালাল। তার মতো আরও কয়েকজন দালাল সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফাইলের অগ্রগতি নিশ্চিত করেন। মাহমুদ (ডিসির ভাই পরিচয়দানকারি), সাইফুল, সবুজ ও অপু নামের এরা কথিতভাবে “ওমেদার” হলেও বাস্তবে তারা এলাকার ভয়ঙ্কর ভূমিদস্যু। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অফিসের কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নাজির ছলিমুল্লাহ সরাসরি টাকা আদায় ও লেনদেনের দায়িত্বে আছেন। সালাউদ্দিন নাজিম ও শিপন অফিসের অঘোষিত সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। মিজানুর রহমান দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইলের রেট নির্ধারণ করেন। সরজমিনে অনুসন্ধান ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের প্রতিটি সদস্যের নিজস্ব দালাল বাহিনী রয়েছে। তারা অফিসের বাইরে বসে কাজের রেট বেঁধে দেয়। ভেতরে ফাইল নিয়ে দরকষাকষি করে দালালরাই। ফলে সাধারণ সেবাপ্রার্থী সরাসরি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না। এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমরা অফিসে ঢুকলেই দালালরা ঘিরে ধরে। কোনো কাজ সরাসরি করতে দেয় না। বলছে এ রেট না দিলে ফাইল চলবে না। আমরা বাধ্য হয়ে টাকা দিই।
আরেকজন বলেন, “আমার পৈত্রিক জমির ওয়ারিশ সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার পর বলা হলো নকশা নাই। ঘুষ দিলাম, তখনই কাজ হলো। অথচ পাশের আরেকজন জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কাজ করলো কারণ সে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে।
দৈনিক সোনালী খবরে একাধিকবার তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলেও চক্রটি ভীত না হয়ে বরং আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঘুষের রেট আগের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে তারা হুমকি ও হামলার শিকার হয়েছেন। অফিসকর্মচারীরা দালালদের পক্ষে কথা বলে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখান। অনেক সময় ফাইল চুরি বা গায়েব করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের ক্ষমতা এতটাই অটুট যে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনের ভেতরের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহযোগিতায় তারা বহাল তবিয়তে চলছে। প্রতিমাসে মিসকেস, জমাভাগ, নামজারি, খতিয়ান, খারিজ ও রিট কেসের নামে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নগদ টাকা তাদের বিশেষ খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশ্বস্ত এক কর্মচারী ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এ টাকা ভাগ হয়ে যায় উপরের পর্যায়ে, যার কারণে এতদিন ধরে চক্রটি অক্ষত রয়েছে।
চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী শিপন। একসময় তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এখন অফিসে বসেই কোটি কোটি টাকার লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করছেন। সালাউদ্দিন নাজিম তার ডান হাত হিসেবে কাজ করছেন। নাজির ছলিমুল্লাহ সরাসরি টাকা লেনদেনের দায়িত্বে। সার্ভেয়ার মিজান দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ফাইলের অগ্রগতি নিশ্চিত করেন। এভাবেই পুরো অফিস সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, সরকারের সেবা নিশ্চিত করার পরিবর্তে এ অফিস এখন দুর্নীতি ও প্রতারণার কারখানায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ জমির মালিকানা প্রমাণ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। কেউ ঘুষ না দিলে তার কেস ঝুলে থাকে বা বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে বাধ্য হয়ে ঘুষ দিতেই হয়। কেউ কেউ নিজেদের জমি থেকেও উচ্ছেদ হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সোনালী খবরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরও সিন্ডিকেটকে থামানো হয়নি। বরং প্রশাসনের নীরব ভূমিকা তাদের আরও সাহসী করে তুলেছে। জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, সরকার যদি এই দুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয় তবে সেবাপ্রার্থীদের আস্থা ভেঙে পড়বে।
ভূমি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিন্ডিকেটকে ভাঙতে হলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতি তদন্ত করা দরকার। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। না হলে এই অফিস দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষবৃক্ষ হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। নাগরিক সমাজের নেতারা বলেছেন, জনগণের জমি বাঁচাতে এবং প্রশাসনের ভাবমূর্তি রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘুষের মহোৎসব বন্ধ না হলে সরকারি সেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। এক সময় মানুষ সরকারি অফিসে আসতেই ভয় পাবে। এভাবে চলতে থাকলে প্রশাসন দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রমাণিত হলে নাজির ছলিমুল্লাহ, সালাউদ্দিন নাজিম, আসিফ, শিপন, মিজান, মামুদ, সাইফুল, সবুজ ও অপুকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছে ভুক্তভোগীরা। জনগণের ভাষ্য, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় এবং ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে এদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।