গাবতলী স্কুল দুর্নীতিতে কোটি টাকার লুটের নায়ক, দুদকের মামলা, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া ও তার চক্রের দুর্নীতি উন্মোচনে কেঁপে উঠেছে প্রশাসন
- আপডেট: ০৮:৩৬:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০০১
এম এন আলী নাইম :
রাজধানীর গাবতলীতে শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নের নামে সংঘটিত হয়েছে এক ভয়ংকর ও পরিকল্পিত দুর্নীতির কেলেঙ্কারি যা নেতৃত্ব দিয়েছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মোঃ ছাবের আলী, উপসহকারী প্রকৌশলী মোঃ শামস জাভেদ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নির্মাণ প্রকৌশলীর মালিক আবু সাইদ খান। এরা চারজন মিলে এমন এক দুর্নীতির জাল বুনেছেন, যা শুধু সরকারি অর্থ নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই কলঙ্কিত করেছে। গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ না করেই সরকারি তহবিল থেকে ১ কোটি ২২ লাখ ১৯ হাজার ৮০৬ টাকা আত্মসাৎ করেছে এই দুর্নীতিবাজ চক্র। দুদকের সহকারী পরিচালক স্বপন কুমার রায় এই ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন (মামলা নং ৩৬/২০২৫)। মামলার এজাহারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া, ছাবের আলী, শামস জাভেদ ও আবু সাইদ খান পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিদ্যালয়ের ৩য় ও ৪র্থ ফ্লোরের কাজ সম্পন্ন দেখান, অথচ বাস্তবে ভবনটি দ্বিতীয় তলার মাঝামাঝি অংশেই থেমে আছে। তাদের প্রতারণার ফলে সরকারি কোষাগার থেকে কোটি টাকার বেশি অর্থ তোলা হয় কোনো কাজ না করেই। ২০২৫ সালের মে ও জুন মাসে ঠিকাদার আবু সাইদ খান ৩য় ও ৪র্থ চলতি বিলের জন্য প্রায় ২ কোটি ২১ লাখ টাকার আবেদন করেন। কিন্তু মেজারমেন্ট বুক-এ মিথ্যা তথ্য লিখে দেন উপসহকারী প্রকৌশলী শামস জাভেদ, যাচাই ছাড়াই তাতে স্বাক্ষর করেন সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ছাবের আলী, এবং সেই জাল নথি অনুমোদন দেন নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া। এই তিন কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার করে আবু সাইদ খানকে অবৈধভাবে বিল উত্তোলনের সুযোগ করে দেন। কাগজে কলাম উঠেছে পাঁচতলা পর্যন্ত, কিন্তু বাস্তবে দ্বিতীয় তলার পর আর কোনো কাজই হয়নি। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হঠাৎ অভিযান চালায়। কর্মকর্তারা গিয়ে দেখেন যে ভবনের ৪র্থ ও ৫ম তলা সম্পন্ন দেখানো হয়েছে, সেটি আসলে অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে আছে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মরিচা ধরা রড, ভাঙা ইট ও বালু। শিশুদের জন্য যে বিদ্যালয়টি হওয়ার কথা ছিল, সেটি এখন পরিণত হয়েছে এক দুর্নীতির স্মৃতিস্তম্ভে। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও ভয়াবহ তথ্য। গণপূর্ত অধিদপ্তরের পুনঃপরিমাপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাস্তবে কাজ হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার, অথচ বিল দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকারও বেশি। অর্থাৎ ১ কোটি ২২ লাখ টাকার সরকারি অর্থ সরাসরি আত্মসাৎ করেছে এই চার দুর্নীতিবাজ। দুদকের কর্মকর্তারা বলেন মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া ছিলেন পুরো অপকর্মের পরিকল্পনাকারী। ছাবের আলী ও শামস জাভেদ তার নির্দেশে সরকারি নথি জাল করেছেন, আর আবু সাইদ খান সেই সুযোগে কোটি টাকার বিল তুলে নিয়েছেন। দুদকের ভাষায়, এটি কোনো সাধারণ অনিয়ম নয় এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত সরকারি অর্থ লুট। সরকারি অফিসের ভেতরে বসে কাগজে কলমে পুরো ভবন দাঁড় করানো হয়েছে, অথচ বাস্তবে সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে অর্ধনির্মিত এক দালান। এই চক্র সরকারি নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের চরম অপমান করেছে। দুদক কর্তৃপক্ষ মামলাটি অনুমোদন দিয়েছে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারায় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায়। ঘটনাকাল ধরা হয়েছে ১৫ মে থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। ঘটনার স্থান গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলজিইডির ঢাকা জেলা কার্যালয়। দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে যদি আরও কেউ জড়িত প্রমাণিত হয়, তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। এক কর্মকর্তা বলেন, মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া ও তার সহযোগীরা শুধু অর্থ চুরি করেননি, তারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল এলাকার শিশুদের জন্য আধুনিক ও নিরাপদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা। কিন্তু দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও ঠিকাদার চক্রের কারণে বিদ্যালয়টি আজ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যে অর্থে ক্লাসরুম, সিঁড়ি ও ছাদ নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল, সেই অর্থ এখন দুর্নীতিবাজদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। গাবতলীর এই কেলেঙ্কারি স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছে যখন মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া, ছাবের আলী, শামস জাভেদ ও আবু সাইদ খান-এর মতো দায়িত্বহীন দুর্নীতিবাজরা সরকারি প্রকল্পের দায়িত্ব নেয়, তখন উন্নয়ন নয়, জন্ম নেয় ধ্বংস। জনগণের টাকায় গড়ে ওঠার কথা ছিল শিক্ষার মন্দির, কিন্তু তা এখন দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আজ গাবতলীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অর্ধনির্মিত ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতার প্রতীক হয়ে যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি মরিচা ধরা রড যেন চিৎকার করে বলে উঠছে, “এটাই দুর্নীতির বাংলাদেশ!



















