জুলাই আন্দোলনে বিজিবি: ভ্রান্তি বনাম বাস্তবতা

- আপডেট: ১০:৪৫:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৮০০৪
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদুর রহমান (অব.)
২০২৪ সালের জুলাই মাসের সেই উত্তাল দিনগুলোতে গণআন্দোলন তরান্বিত করেছিল আমার মতো সাবেক সেনাকর্মকর্তারা। মিরপুর ডিওএইচএস থেকে থেকে বের হয়ে ছাত্রজনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে অগণিত ছাত্রজনতার একটি মিছিল নিয়ে গণভবন অভিমুখে যাত্রা করি। একই ভাবে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসারস ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনর(রাওয়া) সদস্যবৃন্দ ছাত্রজনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মহাখালীতে অবস্থান নেন। নাটকীয় মোড় নেয় আন্দোলন, স্বৈরাচারী শাসকের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীজন হিসেবে আজ কিছু কথা না বললেই নয়।
গণআন্দোলন দমনে বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে-নির্যাতনে নিহত সব শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলছি, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের অবশ্যই বিচার হতে হবে। তবে বিচারের দাবি যেন অবিচারের পরিবেশ তৈরি না করে, এ ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। একজন সাবেক বিজিবি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমি কিছু প্রচলিত ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করতে চাই।
প্রথমে ডেইলি স্টার, এরপর নেত্রনিউজ জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট দিল- গণআন্দোলন দমনে বিজিবির গুলিতে সারাদেশে ৮০ জন নিহত হয়েছে। কার গুলিতে কে মৃত্যুবরণ করেছে, এটা প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। আদালতের রায় এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। তবে চলমান মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বিজিবির গুলিতে নিহতের যে সংখ্যা দেয়া হলো, তা অতিরঞ্জিত বলে প্রতীয়মান। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নসাপেক্ষও! বর্তমানের মিডিয়ার আধিক্য ও প্রযুক্তির যুগে যেখানে পুলিশের এপিসি থেকে মৃতদেহ ফেলে দেওয়া, পোড়ানো মৃতদেহ গাড়িতে তোলা ইত্যাদি অসংখ্য ভিডিও কিংবা স্থিরচিত্র রয়েছে সেক্ষেত্রে বিজিবি কর্তৃক (দুই এক জন বিজিবি সদস্য কর্তৃক গুলি করার দৃশ্য ছাড়া) এ ধরনের কোন ভিডিও কিংবা ছবি কোথাও দেখতে যায়নি। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্যকে ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই কেননা যে দোষী তার শাস্তি পাওয়া উচিত; তবে সেজন্য একটি স্বনামধন্যবাহিনীকে মৃত্যুর অতিরঞ্জিত সংখ্যার মাধ্যমে ট্যাগ লাগানো সম্পূর্ণ অনাকাঙ্খিত।
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রামপুরা–বনশ্রীর ঘটনাকে ঘিরে সম্প্রতি জুলাই রেভুলশনারি এলায়েন্স (জে আর এ) দাবি করেছে, নিহত ৯৪ জনের মধ্যে ৬৬ জন বিজিবির গুলিতে শহীদ হয়েছে; এই পরিসংখ্যান এখনো কোনো স্বতন্ত্র উৎসে যাচাইযোগ্য হয়নি। প্রকাশ্য নথি, স্বাধীন অনুসন্ধান, গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে কোন নির্ভরযোগ্য মিল পাওয়া যায়নি। অতএব এই সংখ্যাতত্ত্বকে চূড়ান্ত পরিসংখ্যানের বদলে অভিযোগ হিসেবে দেখা উচিত এবং অভিযোগের স্বচ্ছ ও প্রাতিষ্ঠানিক যাচাই অপরিহার্য।
প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কখন এই দাবি করছে জুলাই রেভুলেশনারি এলায়েন্স! কিছুদিন আগেই ঢাকার পিলখানায় বিজিবি-বিএসএফ শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের একতরফা হামলাকারী দায়ী করে আত্মরক্ষার্থে বিএসএফ গুলি করে বলে দাবি করেন বিএসএফ প্রধান। সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনেই এর দ্বিমত করেন বিজিবি মহাপরিচালক। তিনি বলেন, দিনের আলোয় একজন অনুপ্রবেশকারী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন ব্যক্তি কিভাবে বিএসএফের অস্ত্রধারী সৈনিকের জন্য থ্রেট হয় যে তাদের হত্যা করতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর এই প্রথম ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলা শুরু করেছে বাংলাদেশ। সীমান্তে ভারতের বিএসএফের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অপারেশনাল টানাপোড়েনের মুহূর্তে বিজিবিকে দৃশ্যত আরও আত্মবিশ্বাসী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ উত্তেজনার ভাইরাল ভিডিও জনমনে নতুন বোধ তৈরি করেছে। এমন সময়ে প্রমাণহীন বা অতিরঞ্জিত অভিযোগ দিয়ে দেশের সবচেয়ে পুরোনো এই বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল করার ঝুঁকি ডেকে আনে। এটি বিদেশী স্বার্থের সুবিধা, কিংবা নির্বাচনপূর্ব অরাজক রাজনীতির কৌশলেরও অংশ হতে পারে। জেআরএ উদ্দেশ্যমূলক ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে না চাইলেও ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
বিজিবি জনগণের বাহিনী। গ্রামবাংলার মাটির সন্তানরাই এই বাহিনীর মূল শক্তি। জুলাই আন্দোলনে তদানীন্তন সরকারের আদেশে মোতায়েন হয়েছে। তবে কার্যক্ষেত্রে বিবেক দিয়ে পালন করেছে যেন পৃথিবীর হাতে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মৃত্যু না হয়; দুই এক জন সদস্য যাদেরকে সীমা অতিক্রম করতে দেখা গেছে তারা বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। নির্দেশনা থাকার পরও জুলাই আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেনি বিজিবি। হাইকমান্ডের চাপ থাকার পরও বিজিবি কাউকে গ্রেফতার করেনি, এমনকি যৌথবাহিনীর অভিযানেও গণগ্রেফতারে বিজিবি অংশগ্রহণ করেনি। বিজিবি কোথাও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেনি, বিজিবির বিশেষায়িত র্যাপিড অ্যাকশন টিম নামানো হয়নি, এমনকি এপিসি কিংবা পিকআপ এর উপরে কোন অস্ত্র স্থাপন করা হয়নি। এক অত্যুৎসাহী কর্মকর্তার এইমড শটের যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, ঘটনার পরপরই তদন্ত সম্পন্ন করে তাকে মূল বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়।
বহু স্থানে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে বিজিবি কর্তৃক আন্দোলন চলাকালীন চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তার নজিরও আছে। পিলখানার বর্ডার গার্ড হাসপাতালে এখন পর্যন্ত অসংখ্য গুরুতর আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অনেকের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা এখনও চলছে। এমনকি ধানমন্ডির একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনের চিকিৎসা ব্যয়ও পরিশোধ করেছে বিজিবি। শতাধিক আহত ছাত্র জনতাকে পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে নিভৃতে।
আরো একটি বাস্তবতা হলো ভুল সনাক্তকরণের ঝুঁকি। কয়েকটি বাহিনীর পোশাকের প্যাটার্ন কাছাকাছি হওয়ায় ঘটনাস্থলে কে কোথায় ছিল তা নির্ভুলভাবে চিহ্নিত না করে দায় চাপানো হয়তো সহজ, কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক নয়। হয়তো কোনো এক বাহিনীর পোশাক দেখে আন্দোলনকারীরা বিজিবি বলে মনে করেছে, দূর থেকে প্যাটার্ন চোখে ধরা পরলেও কালার ও শেডের সামান্য পার্থক্য তাদের চোখে ধরা পড়েনি। যে কোনো প্রাণহানিই বেদনাদায়ক এবং দায় থাকলে তা অনুসন্ধানের মুখোমুখি হওয়া উচিত। তবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা অনুমাননির্ভর সংখ্যার ভিত্তিতে পুরো বাহিনীকে কালিমালিপ্ত ঘোষণা করা হলে মনোবল ভেঙে পড়ে, মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এখন নির্বাচনী ক্যালেন্ডার ঘনিয়ে আসছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা নাজুক। সীমান্তে পুশ ইন ঠেকানো, মাদক ও চোরাচালান দমনে বিজিবির কঠোরতা বহু প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে বাহিনীকে দুর্বল করার চেষ্টাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োজন তথ্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন, আবেগতাড়িত নয়।
প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্ত নয়, দায়ী হলে জবাবদিহির আওতায়ই রাখতে হবে, তবে সেটি হতে হবে প্রমাণনির্ভর ও শৃঙ্খলাভিত্তিক। নির্বাচনের আগে বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে অযৌক্তিক দাবি তোলা যদি মাঠপর্যায়ের মনোবলকে ভেঙে দেয়, তার অভিঘাত পড়বে সীমান্ত নিরাপত্তা, চোরাচালান দমন ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর।
শেষ কথাটি তাই সরল। তদন্ত হোক, সত্য বের হোক, কোন ছাড় নয়, কাউকে অন্যায় দোষারোপও নয়। সংখ্যা নয়, প্রমাণ কথা বলুক। রাষ্ট্র, নাগরিক ও বাহিনী—সবার স্বার্থেই এখন সবচেয়ে জরুরি হলো তথ্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও ন্যায়সঙ্গত বিচার, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা নয়।