মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে কানুনগোর ঘুষ বাণিজ্য
- আপডেট: ০৬:৫১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০২৭
মোঃ মনিরুজ্জামান মনির
মতিঝিল রাজস্ব সার্কেল আজ পরিণত হয়েছে ঘুষ বাণিজ্যের আস্তানায়। যেখানে সরকারি চাকরিজীবীর সততা নয়, বরং দুর্নীতি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে অলিখিত আইন। অফিসের প্রতিটি কোণে চলছে টাকার খেলা, আর এই অন্ধকার সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কানুনগো মোকলেস ও তার ছায়াসঙ্গী কুখ্যাত দালাল শফিক।
১৮৬৬ বর্তমান অর্থবছরের কেসে ঘুষের পরিমাণ কম হওয়ায় নথি না মঞ্জুরের জন্য নিজেই সুপারিশ করেন কানুনগো। প্রকৃতপক্ষে কথিত ওমেদার দালাল শফিক স্বয়ং এসিল্যান্ডের নাম ভাঙ্গিয়ে সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে ইতোমধ্যেই ৭৫ হাজার টাকা নেয়। কিন্তু এরপরও কানুনগো মোকলেস আরো বেশি টাকা চায় এবং না পেয়ে উক্ত ১৮৬৬ নম্বর কেসটি না মঞ্জুরের সুপারিশ করেন। সরকারি নীতির প্রতি এমন ঔদ্ধত্য দেখিয়ে তিনি যেন প্রমাণ করছেন ঘুষই এখানে নিয়ম, সততা বরং অপরাধ। অভিযোগ রয়েছে, এই কানুনগো চলতি অর্থবছরেই এলপিআরে যাচ্ছেন, আর অবসরে যাওয়ার আগে শেষ সুযোগ হিসেবে রাজস্ব অফিসকে বানিয়ে ফেলেছেন নিজের ব্যক্তিগত আখের গোছানোর কারখানা। ফলে এখন তিনি দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া ছুটাচ্ছেন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই।
অফিসের নিয়ম সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা, কিন্তু মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে রাত গভীর পর্যন্ত আলো জ্বলে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসে থাকে বহিরাগত দালাল ও কিছু স্টাফদের আনাগোনা। সচেতন মহলের প্রশ্ন— এটি কি সরকারি রাজস্ব অফিস, না কি কোনো গোপন নাইট স্কুল! এই অস্বাভাবিক উপস্থিতি ও মধ্যরাতের দর-কষাকষি থেকেই স্পষ্ট, এখানে চলছে ঘুষের অন্ধ লেনদেন, যেখানে সরকারি নথি নয়, বরং টাকার বান্ডিলই নির্ধারণ করে ন্যায় ও অন্যায়ের সীমারেখা।
দালাল শফিকের পরিচয়ই যেন এক রহস্য। নিজেকে কখনো ওমেদার, কখনো অফিস সহকারী দাবি করলেও বাস্তবে সে কানুনগো মোকলেসের ডান হাত (দালাল)। অফিসে কোনো কাজ করতে গেলে প্রথমেই তার সামনে পড়তে হয়। জমির নামজারি, রেকর্ড সংশোধন কিংবা মিস কেস নিষ্পত্তি— কিছুই তার অনুমতি ছাড়া এগোয় না। ঘুষের টেবিল সাজিয়ে রেখেছে সে, কে কত দেবে তার তালিকা তৈরি করে আগেই। এক কাজের জন্য তিন ধাপে টাকা ভাগ হয় প্রথমে শফিক, এরপর কানুনগো মোকলেস, তারপর নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির। এই “তিন দফা ঘুষনীতি” এখন মতিঝিল অফিসের অব্যক্ত সংবিধান।
মোকলেসের অতীতও কলঙ্কিত। তিনি আগে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন, সেখানেই ঘুষ বাণিজ্যের চর্চায় হয়ে ওঠেন পাকা খেলোয়াড়। মতিঝিলে বদলি হয়ে এসে পুরনো দালাল শফিককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন ঘুষ সাম্রাজ্য। বাইরে থেকে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অফিসে টেনে আনা হয়, পরে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল অর্থ। কেউ ঘুষ দিতে না চাইলে তাদের ফাইল হারিয়ে যায়, বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল দেখিয়ে মিস কেস বানানো হয় যাতে আবার নতুন করে আবেদন দিতে হয়। নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির এই চক্রের তৃতীয় স্তম্ভ। সরকারি ফি ১০০ টাকা হলেও সাধারণ মানুষকে দিতে হয় পাঁচগুণ বা দশগুণ টাকা। অভিযোগ আছে, এই টাকা পরবর্তীতে কানুনগোর টেবিল হয়ে উপরে ভাগ যায়। একধরনের পিরামিড কাঠামো তৈরি হয়েছে যেখানে দালাল থেকে শুরু করে কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই অংশীদার। ফলে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে সম্পূর্ণরূপে। অফিসে দুর্নীতিবিরোধী পোস্টার ঝুলছে, সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, যেসব ঘরে ঘুষ লেনদেন হয়, সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যামেরার ভিউ সরিয়ে রাখা হয় যাতে কোনো প্রমাণ ধরা না পড়ে। ফলে সব অনিয়ম চলে নির্ভয়ে, যেন দুর্নীতি এখানে এক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি। একজন প্রবীণ সেবা প্রত্যাশী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই অফিসে টাকা ছাড়া কেউ কথা বলে না। ফাইল নড়াতে চাইলে টেবিলের নিচে টাকা দিতে হয়। শফিক নামের ওই দালালের অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না। তার মতো অসংখ্য নাগরিক প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের এই ভয়ংকর সিন্ডিকেট শুধু ঘুষ নয়, ভয়ভীতিও ব্যবহার করে। দালাল শফিক প্রকাশ্যে বলে, “সবাই জানে উপরে কারা আছে, আপনি কিছু করতে পারবেন না।” এই কথায় বোঝা যায় চক্রটি কতটা প্রভাবশালী এবং তাদের পিছনে কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। অনেকে ভয় পেয়ে অভিযোগ করতেও সাহস পান না। সরকারি রাজস্ব প্রশাসন আজ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে সেবার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ন্যায়বিচার। সাধারণ মানুষ আজ বুঝে গেছে, মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে সততা মানে বিলম্ব, আর ঘুষ মানে দ্রুত সমাধান। কানুনগো মোকলেস ও দালাল শফিকের এই দুর্নীতির জাল ভেঙে না দিলে প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের এই অন্ধকার দুনিয়া এখন সরকারি ব্যবস্থার নৈতিক পতনের প্রতীক। শফিক-মোকলেস-নাসির চক্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঘুষ সিন্ডিকেট ধ্বংস না হলে সরকারি রাজস্ব অফিসগুলো ক্রমেই জনগণের শত্রুতে পরিণত হবে। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই প্রয়োজন কঠোর তদন্ত, দালালদের গ্রেপ্তার এবং কানুনগো মোকলেসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। অন্যথায় মতিঝিল রাজস্ব সার্কেল হয়ে উঠবে দুর্নীতির অজেয় দুর্গ, যেখানে ন্যায় ও সেবার কোনো স্থান থাকবে না।




















