পোস্টাল ভোটিংয়ে ব্যয় ৪৯ কোটি টাকা, ১৫ কোটিই যাবে পরামর্শকের পকেটে

- আপডেট: ১২:২০:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৮০১২
আলমগীর মতিন চৌধুরী:
বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে ‘দেশের বাইরে ভোটদান সিস্টেম উন্নয়ন এবং বাস্তবায়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় একজন টিম লিডারের (পরামর্শক) জন্য বেতন ধরা হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২৩ মাস কাজের বিনিময়ে বেতন হিসেবে তিনি এ পরিমাণ অর্থ পাবেন। একই সময়ে প্রকল্পের গভর্ন্যান্স অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক প্ল্যানিং খাতে একজন পরামর্শকের জন্য বেতন ধরা হয়েছে ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পোস্টাল ভোটের জন্য নতুন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৯ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। যেখানে প্রকল্পের আওতায় ৩০ জন পরামর্শকের জন্য ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৬৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এই পরামর্শকরা ২৩ মাস কাজ করে এ অর্থ তুলে নেবেন, যা প্রকল্প ব্যয়ের মোট অর্থের ৩১ দশমিক ৭২ শতাংশ। প্রকল্পটি ৫০ কোটি টাকার কম হওয়ায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) থেকে অনুমোদন নিতে হয়নি। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এটি অনুমোদন করেন। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত এ প্রকল্প গত ১৯ আগস্ট জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার) হয়েছে। ২০২৫ সালের জুন থেকে ২০২৭ মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কমিশন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুরো প্রকল্পের ব্যয় সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে। তবে পরামর্শক নিয়োগ খাতে প্রস্তাবিত ব্যয়কে দেশীয় মুদ্রা বিবেচনায় ‘বাড়তি’ বলছে পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘বিদেশি ফার্মের ব্যয় অনেক। আমি একটি প্রতিষ্ঠানে ছিলাম, সেখানে এক প্রকল্পে ইন্টারন্যাশনাল কস্ট ছিল ৮০ শতাংশের বেশি, বাকিটা ছিল পরিবহন খাতে, আর কিছু অংশ ছিল যন্ত্রপাতি কেনার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পোস্টাল ভোটিং প্রকল্পটি কনসালটেন্স সার্ভিস ওরিয়েন্টেড। এ প্রকল্পটি মূলত ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাবিলিটি রিলেটেড। ফলে পরামর্শক খাতে এ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে দেখা গেছে, একই সময় অর্থাৎ ২৩ মাস কাজ করে একেকজন কনসালটেন্ট প্রকিউরমেন্ট, কনসালটেন্ট বিজনেস অ্যানালিস্ট ও সিনিয়র প্রোগ্রামার ৬৯ লাখ টাকা করে বেতন পাবেন। একই পরিমাণ (৬৯ লাখ) বেতন ধরা হয়েছে প্রত্যেক কনসালটেন্ট ব্লকচেইন ডেভেলপার ও কনসালটেন্ট ক্রিপ্টোগ্রাফির জন্য। এছাড়া কনসালটেন্ট ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও সলিউশন আর্কিটেক্টের ৭১ লাখ এবং কনসালটেন্ট ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের বেতন ধরা হয়েছে ৫৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, টেলেক্স (ওটিপি ই-মেইল) বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা। এছাড়া সমীক্ষা ফি বাবদ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা। জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবনা ধরেই প্রকল্প অনুমোদন করেছে পরিকল্পনা কমিশন। ব্যয় প্রস্তাবে তেমন কাটাছেঁড়া করা হয়নি। প্রকল্পটির আওতায় আপ্যায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এছাড়া প্রশিক্ষণ খাতে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র কেনায় ১৪ লাখ টাকা, ডাটা সংরক্ষণ খাতে চার কোটি ২১ লাখ টাকা ও সম্মানী বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সরঞ্জামাদি কেনায় আট কোটি ৩২ লাখ টাকার ব্যয় প্রস্তাব করেছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পটি হাইলি টেকনিক্যাল। উপযুক্ত পরামর্শক প্রয়োজন হবে। সবকিছু বিবেচনা করেই নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবটি আমরা অনুমোদন করেছি। প্রকল্পটি জিও হয়ে গেছে।’
প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে—প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি ভোটারদের ভোটদানের লক্ষ্যে পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন; দেশের অভ্যন্তরে আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য ভোটারদের জন্য পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় অনলাইন ভোটিং পদ্ধতি প্রণয়ন, নিরাপত্তা, ব্যবহারযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
ইসি জানায়, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা। এছাড়া এ প্রতিষ্ঠান সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে অন্যান্য কার্যক্রমও পরিচালনা করে আসছে।
কমিশন বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৭ লাখ, যার মধ্যে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোটার বিদেশে অবস্থান করছেন এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। অথচ এই প্রবাসীরা জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটদান কার্যক্রম থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন ভোট দিতে পারেন সে বিষয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পোস্টাল ভোটিং প্রকল্পকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলছে নির্বাচন কমিশন। প্রবাসীরা দূর দেশে বসে কীভাবে ভোটে অংশ নেবেন, এ বিষয়ে পদ্ধতি ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি—এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি গবেষণা ও বাস্তবতা যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারদের জন্য তিন ধরনের ভোটদান পদ্ধতির সুপারিশ করেন। এসব সুপারিশের মধ্যে ছিল—অনলাইন ভোটিং (শুধু ডেভেলপমেন্ট), পোস্টাল ভোটিং (প্রবাসী ভোটার ও দেশের অভ্যন্তরে আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য ভোটারদের জন্য) এবং প্রক্সি ভোটিং। পরবর্তীসময়ে রাজনৈতিক অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি আপাতত স্থগিত করা হয়। তুলনামূলক অনলাইন ও পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতিকে কার্যকর, নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে বিবেচনা করে ইসি।
এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন। প্রকল্পটি বাস্তবে রূপ দিতে একটি পূর্ণাঙ্গ সফটওয়্যারনির্ভর ভোটিং সিস্টেম ডিজাইন, ডেভেলপ ও বাস্তবায়নের কাজ করা হবে, যা অনলাইন এবং পোস্টাল ভোটিং উভয় পদ্ধতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটদান সহজ করবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রতি অঙ্গীকার হিসেবে প্রতিফলিত হবে। যেখানে কোনো নাগরিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। সিস্টেমটি এমনভাবে ডিজাইন করা হবে যেন এটি নিরাপদ, ব্যবহারবান্ধব, সংশয়কালীন সম্প্রসারণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক নির্বাচনী মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
ইসি বলছে, নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। প্রবাসীদের ভোটে যুক্ত করা গেলে ভোটের হার যেমন বাড়বে, তারাও ভোটাধিকার ফিরে পাবে। এতে নির্বাচন আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।