নির্বাচনে সহযোগিতায় প্রস্তুত সেনাবাহিনী

- আপডেট: ১০:৩৮:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
- / ১৮০১৯
নিজস্ব প্রতিবেদক
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। তিনি বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। দেশ এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা সেনানিবাসে নিয়মিত মতবিনিময় সভা ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এতে পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আর দেশের অন্য সকল সেনানিবাস ও জাতিসংঘ মিশনে মোতায়েন সেনা অফিসাররা ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান অফিসারদের উদ্দেশে প্রায় ৩৮ মিনিট বক্তব্য রাখেন এবং প্রায় এক ঘণ্টা অফিসারদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে এত দীর্ঘ সময় দেশের সেনাবাহিনীকে মাঠে থাকতে হয়নি। তাই সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, দূরত্ব থাকলে তা দূর করতে হবে। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন। মাঠে দায়িত্ব পালনের সময় সকল সদস্যকে পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না।
কারো নাম উল্লেখ না করে ওয়াকার উজ জামান বলেন, একজন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ তদন্তাধীন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়াতে পারবেন না। আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে। নৈতিক স্খলনের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বলেন, একজন সেনা কর্মকর্তাকে ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। তাই সেনাবাহিনীর কেউ যাতে অপরাধে জড়াতে না পারেন, সে বিষয়ে আগেভাগেই খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সেটি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে অনেক ধরনের কটূক্তির বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে এসব কটূ্িক্ত-মন্তব্যে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। এ বাহিনীকে নিয়ে যারা এসব করছে-বলছে তাদের বয়স কম, আমাদের সন্তানের বয়সী। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে, তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। এসব দেখে সেনা সদস্যদের বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। সতর্ক থাকতে হবে যাতে কেউ ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে সেনাবাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্ট করতে না পারে। তিনি বলেন, দেশের মানুষ এখন সেনাসদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ রাখতে হবে।
ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর নিয়মিত এই মতবিনিময় সভা ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ সেনাপ্রধান অফিসারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং পর্যালোচনা করেন। সেনাপ্রধান অফিসারদের উদ্দেশে বলেন, ইতোমধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘোষিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনে সকল সেনা সদস্যকে আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি মহল বিভিন্ন হীন স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে আমাদের ঐক্য ও পেশাদারী আচরণের কারণে তাদের হীন উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি। আলোচনায় কারো কারো বিরুদ্ধে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে উল্লেখ করে সেনা প্রধান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সতর্ক করে বলেন, এ হেন অপরাধের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন আমাদের জীবনসঙ্গীদের সাথে প্রতারণা করি; অন্যদিকে আমাদের সন্তানদের জীবনকেও অযাচিতভাবে হুমকির মুখে ফেলি। তাই তিনি সকলকে সতর্কতার সাথে এরূপ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে এবং অধীনস্থদেরকেও বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেন। তিনি সেনাসদস্যদের পরিবারের প্রতি অধিক যতœশীল হওয়া এবং সন্তানদের যথাযথভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সহকারে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। বিশেষ করে সন্তানদের মধ্যে আচরণমূলক সমস্যা ও মাদকে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। তিনি জানান, সেনা সদস্যের সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অযাচিত প্রচারণা চলমান রয়েছে। প্রচলিত সেনা আইন ও প্রথা অনুযায়ী অভিযুক্ত সেনা সদস্যের সংঘটিত সকল অন্যায়েরই বিচার হয়ে থাকে। তবে সকলকে মনে রাখতে হবে যে, অপ্রতুল প্রমাণ এর ভিত্তিতে অপ্রয়োজনীয় দ্রুততার সাথে বিচার করলে তা ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ সংগ্রহ করে চলমান সকল অভিযোগের বিষয়েই যথাযথ বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও এর সদস্যদের বিরুদ্ধে চলমান অপপ্রচারের বিষয়ে সেনাপ্রধান সকলকে ধৈর্য্য ধারণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের বিভিন্ন স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে এমন কাজ করছে। এসবের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পেশাদারী আচরণ করাই শ্রেয়। তবে এই সকল অপরাধ যথাযথভাবেই লিপিবদ্ধ থাকছে এবং উপযুক্ত সময়ে এই সকল দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সেনাবাহিনী ও সেনা সদস্যদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর করা কটূক্তির বিষয়ে একজন কর্মকর্তা উল্লেখ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। এই প্রেক্ষিতে সেনা প্রধান পুনরায় সকলকে ধৈর্য্য ধারণ এবং উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন।
সেনাবাহিনীর ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ এ ওয়াকার উজ জামান সেনা প্রথা ও আইন অনুযায়ী সেনা সদস্যদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা, মাদক হতে দূরে থাকা, ইন এইট টু সিভিল পাওয়ার কর্তব্য পালনের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করবার সময়ে কোন জীবনহানি বা আহত হবার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা, যানবাহন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, সেনা সদস্যদের মাঝে আত্মহত্যা করবার প্রবণতা বৃদ্ধি এবং এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন।
দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে নিরলস ভাবে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনীর সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানান ওয়াকার উজ জামান। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনী এবং বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের প্রতি সবসময়ই কৃতজ্ঞ থাকবে।
এর আগে গত ২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেস এ বক্তৃতা করেছিলেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। সে সময় ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে’ মন্তব্য করেছিলেন।