০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অভিযোগ থাকলেও টলেনি প্রশাসন, ধরাছোঁয়ার বাইরে শামীম ওসমানের স্নেহভাজন মামুন সিন্ডিকেট

  • আপডেট: ০৮:৪৩:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫
  • / ১৮০২১

মোঃ মনিরুজ্জামান মনির:
দেশের ভুমি অফিসে এখন সেবাপ্রত্যাশিদের মুখে মুখে এক নতুন প্রবাদ—“যেখানে জমির কাগজ, সেখানেই ঘুষের ভাগ।” এই বাস্তব চিত্র যেন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়। অভিযোগ রয়েছে, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সার্ভেয়ার মো. মামুন হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন কানুনগো এবিএম হাবিব উল্লাহ, সার্ভেয়ার আনোয়ার হোসেন এবং সড়ক ও জনপথের সার্ভেয়ার দেওয়ান মো. সোহাগ। ২০১৯ সালে নারায়নগঞ্জের প্রভাবশালী আ.লীগ গডফাদার শামীম ওসমানের তদবিরে বদলি হয়ে আসেন সার্ভেয়ার মামুন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের ব্যাপক বদলির সময়ও বহাল তবিয়তে থেকে যান তিনি। প্রকাশ্যে তিনি দাবি করেন, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এডিসি সবাই তার ডান হাতে। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অধিগ্রহণ কার্যক্রমে নাল জমিকে ভিটি বা বাণিজ্যিক হিসেবে দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি। যে ঘুষ দিয়েছে তার জমি বাণিজ্যিক, আর যে দেয়নি তার জমি থেকে গেছে ভিটি বা সাধারণ দোকান শ্রেণিতে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের অধিগ্রহণ কার্যক্রমে (এলএ কেস নং ২১/২০২১-২০২২) মামুন সিন্ডিকেট প্রায় ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে সরকারের প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অভিযোগে বলা হয়েছে, বরপা, খাদুন, আধুরিয়া, মাহনা ও আড়িয়াবসহ একাধিক মৌজায় একই শ্রেণির জমি ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে কেবল ঘুষের অঙ্ক অনুযায়ী। কারও দোকানকে বানিজ্যিক করা হয়েছে, কারও দোকান আবার দোকানই থেকে গেছে। এমনকি ৪(১) ধারা নোটিশ জারির পরও অবৈধভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও স্থাপনা অনুমোদন করানো হয়েছে।
সার্ভেয়ার মামুনের জীবনযাপন এবং সম্পদও চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। সরকারি ১২ গ্রেডের এই কর্মকর্তার সর্বোচ্চ বেতন যেখানে ৪০ হাজার টাকা, সেখানে তার বিলাসবহুল টয়োটা প্রিমিও গাড়ি, পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে জমি, উত্তরা ও মীরহাজারি বাগে কোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে স্ত্রী বিথি অহির নামে ফ্ল্যাট, বায়িং হাউজ ‘ইকরা লাইট হাউজ’, পটুয়াখালীতে বাবার নামে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার জমি—সব মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদের পাহাড়। জেলা প্রশাসকের পাশেই ১৫ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ব্যক্তিগত অফিস খুলে সেখান থেকেই প্রতিদিন লেনদেন চালান তিনি।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়া অভিযোগপত্র থেকে এসব তথ্য প্রকাশ পায়। এ ছাড়া বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। ডকেটিং নম্বর ৪০৫৫, স্মারক নম্বর ০৫.৪১.৩০০০.০০০.০০৯.৯৯.০৪০৪.১৮.২০৫৪, তারিখ ৯/৪/২৫, এই নথিতে উল্লেখ রয়েছে যে, রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় এলএ কেস নং ২১/২০২১-২০২২ এর অধিগ্রহণে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে। অভিযোগকারী মো. একরামুল হক তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন, এলএ কেস নং ১/২০২৫-২০২৫ এ আরএস দাগ ৭২৪৯ নম্বর সম্পত্তিতে মিথ্যা পাকা স্থাপনা দেখিয়ে সরকারকে বিপুল রাজস্ব ক্ষতির মুখে ফেলা হয়েছে।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় মামুন সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে অদৃশ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শুধু জেলা পর্যায়ের নয়, এ সিন্ডিকেটের হাত দীর্ঘ। বিভাগের কমিশনার থেকে শুরু করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা পর্যন্ত তাদের মাশোহারা পেয়ে থাকেন। এজন্যই মামুন গংদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ থাকা স্বত্বেও তারা গর্বভরে বলে বেড়ায়, “আমাদের কিছুই হবে না। গ্রাহকদের হয়রানী ও জিম্মি করে অর্থআত্মসাতের পুরস্কার স্বরুপ মামুনকে তড়িঘড়ি করে নারায়নগঞ্জ বন্দর উপজেলা ভুমি অফিসে বদলি করেন জেলা প্রশাসক। দেশে যখনই কোন দুর্নীতিবাজের খবর প্রকাশ হয় তখনই সেই দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীকে বাচাতে রাঘব বোয়ালরা দৃশ্যমান শাস্তি হিসেবে লোকদেখানো বদলি করাকেই বেছে নেয়। তবে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা এসব দুর্নীতিবাজদের চাকরী থেকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির গোপন মাশোহারা কাদের পকেটে যায় তা সেবাপ্রত্যাশিদের অজানা থাকলেও তারা প্রতিনিয়ত ভোগ করছেন ভোগান্তি আর আর্থিক ক্ষতি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কেবল বদলি বা সাময়িক বরখাস্ত নয়, চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করে আইনের আওতায় আনা উচিত। প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়রা বলছেন, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে নারায়ণগঞ্জ ভূমি অধিগ্রহণ শাখা দেশের অন্যতম দুর্নীতির আখড়া হিসেবেই থেকে যাবে।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

অভিযোগ থাকলেও টলেনি প্রশাসন, ধরাছোঁয়ার বাইরে শামীম ওসমানের স্নেহভাজন মামুন সিন্ডিকেট

আপডেট: ০৮:৪৩:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

মোঃ মনিরুজ্জামান মনির:
দেশের ভুমি অফিসে এখন সেবাপ্রত্যাশিদের মুখে মুখে এক নতুন প্রবাদ—“যেখানে জমির কাগজ, সেখানেই ঘুষের ভাগ।” এই বাস্তব চিত্র যেন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়। অভিযোগ রয়েছে, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সার্ভেয়ার মো. মামুন হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন কানুনগো এবিএম হাবিব উল্লাহ, সার্ভেয়ার আনোয়ার হোসেন এবং সড়ক ও জনপথের সার্ভেয়ার দেওয়ান মো. সোহাগ। ২০১৯ সালে নারায়নগঞ্জের প্রভাবশালী আ.লীগ গডফাদার শামীম ওসমানের তদবিরে বদলি হয়ে আসেন সার্ভেয়ার মামুন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের ব্যাপক বদলির সময়ও বহাল তবিয়তে থেকে যান তিনি। প্রকাশ্যে তিনি দাবি করেন, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এডিসি সবাই তার ডান হাতে। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অধিগ্রহণ কার্যক্রমে নাল জমিকে ভিটি বা বাণিজ্যিক হিসেবে দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি। যে ঘুষ দিয়েছে তার জমি বাণিজ্যিক, আর যে দেয়নি তার জমি থেকে গেছে ভিটি বা সাধারণ দোকান শ্রেণিতে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের অধিগ্রহণ কার্যক্রমে (এলএ কেস নং ২১/২০২১-২০২২) মামুন সিন্ডিকেট প্রায় ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে সরকারের প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অভিযোগে বলা হয়েছে, বরপা, খাদুন, আধুরিয়া, মাহনা ও আড়িয়াবসহ একাধিক মৌজায় একই শ্রেণির জমি ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে কেবল ঘুষের অঙ্ক অনুযায়ী। কারও দোকানকে বানিজ্যিক করা হয়েছে, কারও দোকান আবার দোকানই থেকে গেছে। এমনকি ৪(১) ধারা নোটিশ জারির পরও অবৈধভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও স্থাপনা অনুমোদন করানো হয়েছে।
সার্ভেয়ার মামুনের জীবনযাপন এবং সম্পদও চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। সরকারি ১২ গ্রেডের এই কর্মকর্তার সর্বোচ্চ বেতন যেখানে ৪০ হাজার টাকা, সেখানে তার বিলাসবহুল টয়োটা প্রিমিও গাড়ি, পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে জমি, উত্তরা ও মীরহাজারি বাগে কোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে স্ত্রী বিথি অহির নামে ফ্ল্যাট, বায়িং হাউজ ‘ইকরা লাইট হাউজ’, পটুয়াখালীতে বাবার নামে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার জমি—সব মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদের পাহাড়। জেলা প্রশাসকের পাশেই ১৫ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ব্যক্তিগত অফিস খুলে সেখান থেকেই প্রতিদিন লেনদেন চালান তিনি।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়া অভিযোগপত্র থেকে এসব তথ্য প্রকাশ পায়। এ ছাড়া বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। ডকেটিং নম্বর ৪০৫৫, স্মারক নম্বর ০৫.৪১.৩০০০.০০০.০০৯.৯৯.০৪০৪.১৮.২০৫৪, তারিখ ৯/৪/২৫, এই নথিতে উল্লেখ রয়েছে যে, রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় এলএ কেস নং ২১/২০২১-২০২২ এর অধিগ্রহণে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে। অভিযোগকারী মো. একরামুল হক তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন, এলএ কেস নং ১/২০২৫-২০২৫ এ আরএস দাগ ৭২৪৯ নম্বর সম্পত্তিতে মিথ্যা পাকা স্থাপনা দেখিয়ে সরকারকে বিপুল রাজস্ব ক্ষতির মুখে ফেলা হয়েছে।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় মামুন সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে অদৃশ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শুধু জেলা পর্যায়ের নয়, এ সিন্ডিকেটের হাত দীর্ঘ। বিভাগের কমিশনার থেকে শুরু করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা পর্যন্ত তাদের মাশোহারা পেয়ে থাকেন। এজন্যই মামুন গংদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ থাকা স্বত্বেও তারা গর্বভরে বলে বেড়ায়, “আমাদের কিছুই হবে না। গ্রাহকদের হয়রানী ও জিম্মি করে অর্থআত্মসাতের পুরস্কার স্বরুপ মামুনকে তড়িঘড়ি করে নারায়নগঞ্জ বন্দর উপজেলা ভুমি অফিসে বদলি করেন জেলা প্রশাসক। দেশে যখনই কোন দুর্নীতিবাজের খবর প্রকাশ হয় তখনই সেই দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীকে বাচাতে রাঘব বোয়ালরা দৃশ্যমান শাস্তি হিসেবে লোকদেখানো বদলি করাকেই বেছে নেয়। তবে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা এসব দুর্নীতিবাজদের চাকরী থেকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির গোপন মাশোহারা কাদের পকেটে যায় তা সেবাপ্রত্যাশিদের অজানা থাকলেও তারা প্রতিনিয়ত ভোগ করছেন ভোগান্তি আর আর্থিক ক্ষতি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কেবল বদলি বা সাময়িক বরখাস্ত নয়, চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করে আইনের আওতায় আনা উচিত। প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়রা বলছেন, জেলা প্রশাসকের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে নারায়ণগঞ্জ ভূমি অধিগ্রহণ শাখা দেশের অন্যতম দুর্নীতির আখড়া হিসেবেই থেকে যাবে।