ঘুষ ছাড়া সেবা মেলেনা মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে
- আপডেট: ০৭:১১:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০২২
মোঃ মনিরুজ্জামান মনির:
মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না এমন অভিযোগ এখন আর গোপন নয়, বরং এটি যেন এক প্রকাশ্য গোপনীয়তায় পরিণত হয়েছে। অফিসের দেয়ালজুড়ে লেখা আছে “আপনি সিসিটিভি নজরদারির আওতায় রয়েছেন” ও “দুর্নীতি প্রতিরোধে শূন্য সহনশীলতা” কিন্তু এই সতর্কবার্তা যেন কেবল প্রদর্শনের জন্যই টানানো। বাস্তবে অফিসের প্রতিটি কক্ষেই চলছে ঘুষের লেনদেন, নামজারি, মিস কেস কিংবা জমির পরিমাপ সব কিছুই টাকা ছাড়া অচল। মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের তিন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী কানুনগো মোকলেস, নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির এবং কথিত দালাল ওমেদার শফিকের হাতেই বন্দি হয়ে পড়েছে সাধারণ সেবা প্রত্যাশীরা। প্রতিদিন এই তিনজনের নেতৃত্বে চলছে এক ভয়ংকর ঘুষ বাণিজ্যের মহোৎসব, যেখানে প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে।
অফিসে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় এখানে ঘুষের গন্ধ কেমন ছড়ানো। জমির নামজারি করতে গেলে প্রথমেই দালাল শফিকের সঙ্গে দেখা না হলে কোনো ফাইল নড়ে না। শফিক নিজেকে পরিচয় দেয় ওমেদার নামে, কিন্তু বাস্তবে সে মোকলেসের ঘনিষ্ঠ দালাল। সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় কাজ করাতে চাইলে খরচ লাগবে। সেবাপ্রত্যাশীরা জানায়, জমির নথি যাচাই, রেকর্ড সংশোধন কিংবা মিস কেস নিষ্পত্তির জন্য মোকলেসের টেবিলে যেতে হলে প্রথমে শফিককে পারিশ্রমিক দিতে হয়। এরপর ফাইল কানুনগোর টেবিলে উঠলে সেখানে আরেক দফা ঘুষের দাবি আসে। এই টেবিল পার হলেই নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির হাজির হয় বিল জমার নামে আরও টাকা নিতে। এক কাজের জন্য তিন দফা ঘুষ এই নিয়ম এখন মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের অলিখিত সংবিধান।
কানুনগো মোকলেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জানা যায়, তিনি আগে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। সেখানে ঘুষ বাণিজ্যে পারদর্শিতা অর্জন করে মতিঝিলে বদলি হয়ে আসেন। বদলির পর নিজের পুরনো ঘনিষ্ঠ সহযোগী শফিককে সঙ্গে নিয়ে এসে গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী ঘুষ সিন্ডিকেট। অফিসের ভিতরে ও বাইরে এখন তার দালালদের অবাধ আনাগোনা। সাধারণ মানুষ কোনো কাজ করতে গেলে দালাল ছাড়া অফিসের ভেতরে প্রবেশই করা যায় না। মোকলেসের আশেপাশে কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও যুক্ত করা হয়েছে এই নেটওয়ার্কে, যারা বাইরে থেকে জনসাধারণকে প্রলোভন দেখিয়ে ভেতরে টেনে আনে এবং পরে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়।
নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির এই চক্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সরকারি বিল, নামজারি ফি, দলিলের কপি সবকিছুতেই তার কমিশনের ভাগ নির্ধারিত। অভিযোগ আছে, সরকারি নির্ধারিত ফি ১০০ টাকা হলেও সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। নাসির এই টাকা অফিসের উপরের টেবিলে ভাগ করে দেয় বলে জানা গেছে। ফলে এই রাজস্ব সার্কেলে একপ্রকার পিরামিড আকারে ঘুষ বণ্টনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে নিচের দালাল থেকে শুরু করে অফিসের উর্ধ্বতন পর্যন্ত সবাই ভাগ পান।
ভূমি অফিসের এমন দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। এক নামজারি সম্পন্ন করতে যেখানে এক সপ্তাহের কথা বলা হয়, সেখানে মাসের পর মাস ঘুরেও কাজ শেষ হয় না, যতক্ষণ না ঘুষের টাকা মিলে। কেউ ঘুষ দিতে না চাইলে তার ফাইল হারিয়ে যায়, কাগজে ভুল দেখানো হয় বা মিস কেস দেখিয়ে নতুন করে আবেদন করতে বাধ্য করা হয়। একবার কেউ টাকা দিলে তাকে আবারো একই কৌশলে ফাঁদে ফেলা হয়।
এই চক্রের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্নভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে। এমনকি অভিযোগ উঠলে দালাল শফিক বলেন, উপরে সবাই জানে, আপনি কিছু করতে পারবেন না। এই ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক সেবা প্রত্যাশী মুখ খুলতে সাহস পান না। কেউ কেউ ঘুষের টাকার রসিদ চাইলেও অফিসের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সরাসরি হুমকি দেয় ফাইলটা বন্ধ হয়ে যাবে।
দুর্নীতিবিরোধী পোস্টার টানানো এই অফিসেই এখন দুর্নীতি যেন সরকারি রীতিতে পরিণত হয়েছে। অফিসের গেটে সিসিটিভি লাগানো থাকলেও এই ক্যামেরাগুলো বেশিরভাগ সময় অচল বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বন্ধ রাখা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব ঘরে ঘুষ লেনদেন হয়, সেখানে সিসিটিভির ভিউ ডাইভার্ট করে রাখা হয় যাতে কোনো প্রমাণ ধরা না পড়ে।
মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলে প্রতিদিন শত শত সেবা প্রত্যাশী আসে, কিন্তু প্রকৃত সেবা পান অতি অল্পসংখ্যক লোক—তাও ঘুষ দিয়ে। সাধারণ মানুষ আজ তিক্ত অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে, ঘুষ না দিলে অফিসের কোনো কাজ এগোয় না। এক প্রবীণ নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই অফিসে টাকা ছাড়া ফাইল চলে না, কথা বললেও টাকা লাগে। তার মতে, এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে রাজস্ব প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কানুনগো মোকলেস, নাজির কাম ক্যাশিয়ার নাসির এবং কথিত ওমেদার শফিকের ঘুষ সিন্ডিকেট আজ মতিঝিলের রাজস্ব সার্কেলকে পরিণত করেছে ঘুষের কারখানায়। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, সিসিটিভি ও সতর্কবার্তা সবই যেন এখন এক নিষ্ফল প্রদর্শনী। এই চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা না নিলে রাজস্ব সার্কেলগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে এমন আশঙ্কাই এখন সচেতন নাগরিকদের। মতিঝিলের ঘুষ বাণিজ্যের এই ভয়াবহ চিত্র শুধু একটি অফিসের নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থার নৈতিক পতনের জ্বলন্ত উদাহরণ।




















