ডেসকোর আরিফ-হারুন চক্রের সীমাহীন দুর্নীতি, কোটিকোটি টাকার সম্পদের পাহাড়
- আপডেট: ০৭:৩৫:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০১৪
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
অনিয়ম দুনীতির চাপে ডুবছে ডেসকো। এমএলএসএস আরিফ হারুনের অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ সেবা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষ। ডেসকোর এই দুই কর্মচারি নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। অনিয়ম দুর্নীতির কারণে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) সংকটের মুখে পড়েছে বারবার। একাধিক গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা কর্মচারিরা। অভিযোগ রয়েছে, ডেসকোতে সকল অপকর্মের মাষ্টারমাইন্ড এমএলএসএস মোঃ আরিফুল ইসলাম ও মোঃ হারুন অর রশিদ। এই দুই কর্মচারির অবিশ্বাস্য অর্জিত সম্পদের বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে। অফিসের এমএলএসএস মোঃ আরিফুল ইসলাম ডেসকোর আগারগাঁ ডিভিশনে ও মোঃ হারুন অর রশিদ ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিঃ প্রধান কার্যালয়, খিলক্ষেত ঢাকায় কর্মরত আছেন। এমন কোন অপকর্ম নেই,যা তাদের পরিকল্পনায় ঘটেনা। ঢাকা ইলেকট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ডেসকো নামটি একসময় ছিল সেবা, দায়িত্ব ও জনগণের আস্থার প্রতীক। সেই নাম উচ্চারিত হচ্ছে ভয়, ঘুষ আর দুর্নীতির সমার্থক হিসেবে। অভিযোগ উঠেছে, এই প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন পদে কর্মরত দুইজন ম্যাসেঞ্জার বা এমএলএসএস মোঃ আরিফুল ইসলাম ও মোঃ হারুন অর রশিদ দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করে আসছে। তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়, অপরাধ সাম্রাজ্য। তারা দুজন মিলেই এখন রাজধানীতে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, প্লট, গাড়ি, ব্যাংকে কোটি টাকার এফডিআরসহ বিলাসবহুল জীবনের মালিক। তাদের সরকারি মাসিক বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি নয়। এই দুইজনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিস্তারিত অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর। যেখানে অভিযোগকারী মোঃ সোহাগ হাওলাদার তাদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ডের প্রতিটি দিক খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন। অভিযোগ অনুযায়ী, আরিফুল ইসলাম ডেসকোর আগারগাঁও ডিভিশনে কর্মরত এবং হারুন অর রশিদ খিলক্ষেতের প্রধান কার্যালয়ে চাকরিতে আছেন। কিন্তু চাকরির আড়ালে তারা চালাচ্ছেন দুর্নীতির এমন এক ব্যবসা, যার জাল ছড়িয়ে আছে ডেসকোর প্রতিটি স্তরে। তারা গ্রাহকদের ফাইল আটকে রেখে টাকা না নিলে সংযোগ দেয় না, আবার টাকা পেলে মুহূর্তেই অনুমোদন হয়ে যায়। এই দুজন অফিসের সর্বনিম্ন পদে থাকলেও তাদের ক্ষমতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক কর্মকর্তা পর্যন্ত তাদের ভয়ে নীরব। ডেসকোর অভ্যন্তরে তাদের দাপট এখনআকাশ ছোঁয়া। কাকে বদলি করবে, কে পদোন্নতি পাবে, এমনকি কে অভিযোগ তুলতে পারবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ যেন তাদের হাতেই। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই দুইজন সাবেক পরিচালক নূর মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সেই প্রভাব ব্যবহার করেই তারা বছরের পর বছর ধরে ডেসকোর বিভিন্ন ইউনিটে অনিয়ম, তদবির বাণিজ্য ও ঘুষের রাজত্ব চালাচ্ছে। তারা নূর মোহাম্মদের নাম ব্যবহার করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয় দেখায়, গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, এমনকি অবৈধ সংযোগের নামে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের ঘুষ সংগ্রহ করে। অভিযোগকারী জানিয়েছেন, এই দুইজনের কাছে এমন এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে যা গ্রাহক হয়রানির এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। কোনো গ্রাহক সংযোগের আবেদন করলে ফাইল গায়েব হয়ে যায়, আরিফুল বা হারুনের টেবিল না ঘুরে কোনো কাজ এগোয় না। তারা নিজেরা সরাসরি টাকা নেয় না, বরং মধ্যস্থ দালালচক্রের মাধ্যমে ঘুষ সংগ্রহ করে। টাকা পেলে সংযোগ হয়, না পেলে মাসের পর মাস ফাইল পড়ে থাকে ধুলায়। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো এই দুইজন এখন রাজধানীতে কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক। অভিযোগপত্রে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, দক্ষিণখান থানার বাসা নং ৫৯০, রোড নং ০৩ এই বাড়িটি তাদের যৌথ মালিকানাধীন। একইভাবে সাভার পৌরসভার দিয়া বাড়ী এলাকায় প্রায় ২০ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করেছেন একটি দোতলা ভবন। এর বাইরে সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় সালাতন পাম্পের বিপরীতে সাত শতক জমির ওপর তারা গড়ে তুলেছেন এক বিশাল বাড়ি, যেখানে এখন তারা স্বপরিবারে বসবাস করছে। জমির সুনির্দিষ্ট দাগ নম্বরও উল্লেখ করা হয়েছে, সিএস ও এসএ দাগ ৪৩৫, আরএস দাগ ৪৬২, বিএস দাগ ২৫৯৪। জমিটি কিনতে তারা যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তার কোনো বৈধ উৎস নেই। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আরিফুল ইসলাম ও হারুন অর রশিদ কেবল ব্যক্তিগত ঘুষ বাণিজ্যই চালাচ্ছেন না, বরং সাবেক প্রতিমন্ত্রী, কিছু পলাতক রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ অর্থও তারা নিজেদের নামে গোপনে সংরক্ষণ করছে। এমনকি তাদের স্ত্রীদের নামেও বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। টিআইএন নম্বর রয়েছে, কিন্তু কর রিটার্নে এই বিপুল সম্পদের উৎসের কোনো ব্যাখ্যা নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলেই তারা তাদের ভয় দেখায়, হুমকি দেয় এবং মামলা করার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। আরিফুল ইসলামের এক আত্মীয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে রয়েছেন, তার পরিচয় ও প্রভাব ব্যবহার করে আসছে। একজন সাধারণ ম্যাসেঞ্জার কিভাবে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করছে এটা শুনে বিস্মিত সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনিক মহল। ডেসকোর অভ্যন্তরীণ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই দুইজনের কাছে এমন ক্ষমতা আছে যা অনেক এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারেরও নেই। তারা কার সঙ্গে বসবে, কার সঙ্গে দেখা করবে, কোন ফাইল যাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি কর্মকর্তারা পর্যন্ত জানেন, তাদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক মানে নিজের ট্রান্সফার বা পদোন্নতি বঞ্চিত হবার আশঙ্কা। তারা দীর্ঘদিন ধরে ডেসকো অফিসে এমন এক ঘুষ অপরাধ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে যেখানে গ্রাহকের প্রতিটি সংযোগ, বিল সংশোধন বা নতুন লাইন দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায় করা হয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সংযোগের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ডেসকোর বিভিন্ন এলাকায় এখন এই সিন্ডিকেটকে দুই এমএলএসএস মাফিয়া নামে ডাকা হয়। অভিযোগকারী আরও জানান, তারা বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের ঘুষ নেয়। তারা ডেসকোর কর্মচারীদের ব্যবহার করে গোপনে অবৈধ সংযোগ দেয়, আর বিনিময়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অথচ দুজন এমএলএসএস দিন দিন কোটিপতি হয়ে উঠছে। এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক দুর্নীতির সবচেয়ে জঘন্য রূপগুলোর একটি। একসময় যারা অফিসে চা পৌঁছে দিত, এখন তারাই বিলাসবহুল গাড়িতে ঘোরে, দামি ফ্ল্যাটে থাকে। ব্যাংকের হিসাবে জমা থাকে কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের আর্থিক উৎস যাচাই করেনি। ডেসকোর তৃণমূল কর্মচারীরা অভিযোগ, আরিফ হারুনের সাথে যোগসাজশ না করলে কেউ টিকতে পারে না। যারা বিরোধিতা করে, তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ, বদলি বা হয়রানি শুরু হয়। তারা একাধিক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে বলেই নিরাপদ। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযোগপত্রটি অত্যন্ত বিস্তারিত। টিআইএন নম্বর, ঠিকানা, জমির দাগ, ব্যাংক লেনদেনের প্রাথমিক তথ্য সবই স্পষ্টভাবে দেওয়া আছে। এই অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। জনগণের প্রশ্ন এখন একটাই ডেসকোর এই দুই ম্যাসেঞ্জারের পেছনে আসলে কারা? কে এই দুর্নীতির ছায়া-প্রভু? কেন বছরের পর বছর কেউ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি? ডেসকোর এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, আরিফ হারুন একসময় সাবেক পরিচালক নূর মোহাম্মদের ছায়ায় ছিল, এখন তার অনুপস্থিতিতেও সেই প্রভাব বজায় রেখেছে। মনে হয় যেন ডেসকোর ভেতরে একটি অঘোষিত দ্বিতীয় প্রশাসন চলছে। যার নেতৃত্বে এই দুইজন। অভিযোগে আরও বলা হয়, তাদের হাতে রয়েছে ডেসকোর গ্রাহক সেবা বিভাগের গোপন ডকুমেন্ট। তারা তথ্য ফাঁস করে, সংযোগের তথ্য বিক্রি করে এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে বিদ্যুতের টেম্পারিং করে দেয়। একবার সংযোগ পেলে সেই গ্রাহক আর অভিযোগ করতে সাহস পায় না, কারণ জানে অভিযোগ মানেই ব্ল্যাকমেইল ও সংযোগ বন্ধের ভয়। ডেসকোকে বাঁচাতে হলে প্রথমে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। এই দুইজনকে আইনের আওতায় এনে তাদের ব্যাংক হিসাব, সম্পত্তি, ফ্ল্যাট ও প্লট জব্দ করলে জনগণ জানবে দুর্নীতিবাজের কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই। এখন সবার দৃষ্টি দুর্নীতি দমন কমিশনের দিকে। তদন্ত শুরু হলে হয়তো বেরিয়ে আসবে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য আরও নাম, আরও সিন্ডিকেট, আরও অন্ধকার লেনদেনের গল্প। প্রশ্ন একটাই ডেসকোর দুইজন এমএলএসএস কিভাবে কোটিপতি হলো, কার ছত্রছায়ায়, কতদিন ধরে, এবং রাষ্ট্রের চোখের সামনে এই ভয়ংকর ঘুষ সাম্রাজ্য কতদূর বিস্তৃত হলো। অপরাধের শিকড় উপড়ে ডেসকো আসবে নিয়মে, এমনটি প্রতিবেদনের প্রত্যাশা।




















