যশোর বনোগ্রামে ভূমি দখল ও জোরপূর্বক গাছ কেটে নেওয়ার বীরুদ্ধে সনাতনী পরিবারের নিরাপত্তার দাবিতে এছাড়া সারা দেশের নারী নিখোঁজ ও ধর্ম অবমাননার উদ্বেগ বিষয়ে hrcbm এর সংবাদ সম্মেলন।
- আপডেট: ০২:২৬:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
- / ১৮০৩০
নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
ধর্ম অবমাননার নাম করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনসহ হামলা-মামলা ও জমি দখলের অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কনগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটি (এইচআরসিবিএম)।
একই সঙ্গে সংখ্যালঘু নারী ও কন্যাশিশুদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার,অপহরণ ও শ্লীলতাহানির অবস্থা-লোমহর্ষক বাস্তবতা বলেও জানানো হয়। ফলে সংখ্যালঘু নারীদের উদ্বারের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার এই সংস্থাটি।
সোমবার (০১ডিসেম্বর) বেলা ১২টা নাগাদ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) হিউম্যান রাইটস কনগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটি (এইচআরসিবিএম) আয়োজিত ‘যশোর বনগ্রামে ভূমি দখল ও জোরপূর্বক গাছ কেটে নেওয়ার বিরুদ্ধে সনাতনী পরিবারের নিরাপত্তায় দাবিতে এছাড়া সারা দেশের নারী নিখোঁজ ও ধর্ম অবমাননার উদ্বেগ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব জানানো হয়।
সংবাদ সন্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে মানবাধিকার সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখার কনভেনর অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড় বলেন,সম্প্রতি যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার বনগ্রাম এলাকার সংখ্যালঘু সনাতনী নারী শান্তি রানী ভদ্র এর জমি থেকে জোরপূর্বক গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শান্তি রানী ভদ্র একজন বয়স্কা বিধবা নারী। অসহায় নারী অভয়নগর থানায় অভিযোগ দায়ের করলে ও থানা বিষয়টি এখনো এজাহার ভুক্ত করেন নাই। এ ঘটনা নিছক সম্পদহানি নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ভয়ভীতি প্রদর্শন,যা সংখ্যালঘুদের নিজের জমি সংসার নিয়ে নিরাপদ থাকতে পারছে না। যা সংখ্যালঘুদের জন্য অত্যন্ত বেদনার কথা। সংখ্যালঘু সনাতনী বিধবা নারীর ছেলে ভুক্তভোগী দিপঙ্কর ভদ্র আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি আইনি ও মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বের সংগে পর্যবেক্ষণ করছি। এছাড়া প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
২০২৫ সালে ধর্ম অবমাননার নামে ৭৩টি ঘটনা এক গভীর সংকট জানিয়ে তিনি বলেন,আমাদের সংস্থাটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৭৩টি ধর্ম অবমাননার অভিযোগভিত্তিক ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৪০টি,মামলা হয়নি ৫টি,শিক্ষার্থী বহিষ্কার হয়েছে ৫ জন এবং বাকি ২৩ টি ঘটনার তথ্য সংগ্রহে কাজ চলছে।
খুলনার দাকোপের ঘটনা-আইনের অপব্যবহারের জ্বলন্ত উদাহরণ উল্যেখ করে তিনি বলেন,গত ২৩ অক্টোবর খুলনার দাকোপ থানায় পূর্বায়ন মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
সংস্থাটির অনুসন্ধানের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন,প্রকৃতপক্ষে সনাতন ধর্মের দেবী কালীকে নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি,তার সেই মন্তব্যের জবাব দিতেই তিনি মন্তব্য করেন,অথচ আবদুর রহমান আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমরা থানায় যোগাযোগ করলে ও আজ পর্যন্ত আবদুর রহমানের নামে কোনো মামলা হইনি।
গত ২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর পটুয়াখালী সদরের নাবালক সুব্রত শীল (১৬)’কে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। সুব্রত শীলের পরিবার আমাদের কাছে আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য লিখিত অভিযোগ করে। আমরা হাইকোর্টে জামিনের পিটিশন দায়ের করলে ও আজ পর্যন্ত জামিন পাওয়া যাইনি। এটি প্রমাণ করে,ধর্ম অবমাননার আইনকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা এখন ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরপর আরও বেশ কয়েকটি ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হামলা মামলার ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন,ধর্ম অবমাননাকে ইস্যু করে সংখ্যালঘুদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ঘরবাড়ি লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়,সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাশ আপন এর ঘটনা এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। এছাড়া রংপুরের গঙ্গাচূড়ার পিতা-পুত্র, চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার, বান্ডেল রোড সহ বহু জায়গায় এর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের অপসংস্কৃতি চলতে থাকলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিঃশ্বেষ হতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না। এ যেন এক জাতি গোষ্ঠী-কে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা।
সংখ্যালঘু নারী ও কন্যাশিশুদের অবস্থা-লোমহর্ষক বাস্তবতা জানিয়ে লাকী বাছাড় বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর এই ১১ মাসে সংখ্যালঘু নারীদের ওপর ১৪৪টি সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নিখোঁজ ৬০ জন, অপহৃত ২০ জন, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ২৭ জন, শ্লীলতাহানি ১১ জন, আত্মহত্যা (নির্যাতনের ফলে) ৫ জন, হত্যা ৭ জন, যৌতুক ও পারিবারিক সহিংসতা ১৪ জন। আর এসব ঘটনার মধ্যে ৭৫টি লিখিত অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ২৫ টি ঘটনা সমাধান করেছি এবং ৫০ টি ঘটনা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী অপহরণ-রাষ্ট্রের জবাবদিহি প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলার নাবালিকা দশম শ্রেণীর ছাত্রী (১৫) গত ২৭ নভেম্বর দুপুর ১টার দিকে পরীক্ষার পর বাড়ি ফেরার পথে কালো মাইক্রোবাসে অপহৃত হন। পরিবার, স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসন ঘটনাটি গভীরভাবে অনুসন্ধান করলেও এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এটি শুধু একটি অপহরণ নয়-এটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু কিশোরী মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
এসময় মানবাধিকার এই সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবি গুলো হলো-
১. ধর্ম অবমাননার অপব্যবহার বন্ধে জরুরি আইনগত সংস্কার প্রয়োজন।
২. অনন্যা রূপালি সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু নারীদের উদ্বারের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
৩. সংখ্যালঘুদের জমি দখল, ভয়ভীতি ও হামলার প্রতিটি মামলা নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।
৪. সংখ্যালঘু নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষায় বিশেষ সেল ও মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. মূল অপরাধীদের-প্রভাবশালী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচয় নির্বিশেষে-কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৬. রাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে:
“সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কোনো দয়া নয়, এটি সাংবিধানিক অধিকার।”
এসময় বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, জুলুম ও দমননীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়-সবাইকে এখনই দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হবে যেখানে প্রত্যেক নাগরিক-ধর্ম, পরিচয়, মতবাদ নির্বিশেষে-সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা পাবে।
সংবাদ সন্মেলনে যশোর অভয়নগরে গাছ কেটে নেওয়া ও হামলা মামলার ভুক্তভোগী দীপঙ্কর ভদ্র তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও জানান তিনি।
সংবাদ সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির কোর্ডিনেটর আশীষ কুমার অঞ্জন, হিউম্যান রাইটস এ্যক্টিভিস্ট রিপন দাস, রাজ চাকমা, যশোর ডিভিশনাল কোর্ডিনেটর সঞ্জয় কুমার রাহা ও ভুক্তভোগী দীপঙ্কর ভদ্র।




















