ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মামুন মিয়ার বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্ত শুরু
- আপডেট: ১১:০৫:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
- / ১৮০১৫
নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন মিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সিন্ডিকেট গঠন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের অভিযোগপত্র, ঠিকাদারদের লিখিত অভিযোগ, সাধারণ নাগরিকদের আবেদন এবং সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তার বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে মামুন মিয়াকে ঘিরে ডিএনসিসিসহ প্রশাসনিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা চলছে। অতি সম্প্রতি তাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করেছে সরকার।
এদিকে চলতি মাসেই এই কর্মকর্তার অনিয়মের বিষয়ে ডিএনসিসিতে চারটি অভিযোগ আসার পর নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্ত ও বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজা।
চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর চক্র — মাসিক টার্গেট, ঘুষ না দিলে বদলি
মামুন মিয়াকে নিয়ে ডিএনসিসিতে জমা পড়া এক অভিযোগপত্রে বলা হয়, মামুন মিয়া প্রতি মাসে অঞ্চলভিত্তিক ট্যাক্স অফিসার (টিও), ডেপুটি ট্যাক্স অফিসার (ডিটিও), রেভিনিউ সুপারভাইজার, লাইসেন্স সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেন। সময়মতো চাঁদা না দিলে বদলির হুমকি দেন এবং অনেককে অফিসে ডেকে হেনস্তা করেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে— তিনি রাজস্ব বিভাগের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন। এখন পুরো বিভাগটি দুর্নীতির এক আখরায় পরিণত হয়েছে।”
ঠিকাদারি ফাইল আটকে কোটি টাকার বাণিজ্য
ঠিকাদারদের একাধিক লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, মামুন মিয়া ও তার গঠিত সিন্ডিকেট বিভিন্ন ঠিকাদারি বিলের ফাইল আটকে রাখেন এবং নগদ অর্থ ছাড়া কোনো ফাইল নড়াচড়া হয় না।
এক ঠিকাদার অভিযোগ করেছেন— যেসব ফাইল থেকে টাকা পাওয়া যায় না, সেসব ফাইল সু-কৌশলে আটকে রাখা হয়। এরপর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়।
আরেক ঠিকাদার জানিয়েছেন—প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতিটি ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু কাউকেই কাজ দেননি।
অতিরিক্ত দামে নিম্নমানের ক্রয় — পছন্দের প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব
রাজস্ব বিভাগে ওয়ারলেস সেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে মামুন মিয়া সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে তিনি চাপ প্রয়োগ করেন এবং উচ্চমূল্যে নিম্নমানের সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য করেন। এই বিষয়ে ইতোমধ্যে পত্রিকায়ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাছাই কমিটির কাজে হস্তক্ষেপ — নথি জিম্মি করে কর্মচারীদের পদোন্নতি বন্ধ
অভিযোগকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, প্রশাসক বাছাই কমিটি থেকে মামুন মিয়াকে বাদ দেওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট নথি আটকে রাখেন, যার ফলে বহু কর্মচারী পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন।
অবৈধ সম্পদ ও ইজারা কেলেঙ্কারি
নাগরিক অভিযোগে উঠে এসেছে, মামুন মিয়া—দোকান, হাট–বাজার ইজারা দেওয়ার নামে বিপুল টাকা নেন, বড় বড় হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর জন্য আর্থিক লেনদেন করেন ও কর্পোরেশনের রাজস্ব ক্ষতির বিনিময়ে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ান।
এক অভিযোগে বলা হয়—অবৈধ লেনদেনের কারণে কর্পোরেশন বিপুল রাজস্ব হারিয়েছে। পুরো রাজস্ব বিভাগ তাঁর সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
পেয়েছেন তিরস্কার ও দণ্ডও
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘন করে একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি দায়িত্ব পালন করায় চলতি মাসেই উপসচিব মামুনকে লঘুদণ্ড হিসেবে তিরস্কার করেছে সরকার। চলতি মাসের ৬ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মো. মামুন মিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক (উপসচিব) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় নরসিংদীর ঘোড়াশাল পলাশ করতেতৈল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি যথাযথ অনুমোদন ছাড়া দায়িত্ব নেন। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি-১৭(১)-এর বিপরীতে তিনি সরকারি অনুমোদন ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের পদবি গ্রহণ করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে এটি প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ অভিযোগ আনা হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি অভিযোগনামা জারি করা হয়। মামুন মিয়া ১০ মার্চ লিখিত জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করলে ১৫ এপ্রিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খালেদ মোহাম্মদ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উপসচিবের বিরুদ্ধে আনীত ‘অসদাচরণ’ প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৪(২)(ক) অনুযায়ী মো. মামুন মিয়ার ওপর ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তবে এতেও থামেননি তিনি। শাস্তির পরেও তিনি একই ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযোগকারীরা বলেন—মামুন মিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সরকারের ভাবমূর্তি ও ডিএনসিসির সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে মামুন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, মামুন মিয়াকে ডিএসসিসি থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিবে।





















