মোহাম্মদপুরের কিশোর গ্যাংয়ের ছায়া বনানীর শিসা বারেও!

- আপডেট: ০১:৫২:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
- / ১৮০১১
নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি নতুন নয়। এলাকার অলিগলিতে অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে খুনোখুনির নিত্যদিনের চিত্র। তবে এবার বনানীর শিসা লাউঞ্জে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী রাহাত হোসেন রাব্বীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় উঠে এসেছে মোহাম্মদপুরের দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপের’ নাম।
স্থানীয় ভুক্তভোগী ও রাব্বী হত্যা মামলার বাদীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। গত ১৪ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বনানীর থ্রি সিক্সটি শিসা লাউঞ্জের সিঁড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ী রাব্বী হত্যার ঘটনায় কুমিল্লার বড়ুরা থানার গামরুয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারা হলেন- মো. মুন্না (২৭) ও মাকসুদুর রহমান হামজা (২৬)। এদের মধ্যে মুন্না মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওহিদের ছেলে। মুন্না পাটালি গ্রুপের অন্যতম সদস্য।
চলতি বছরের ১৪ই মে রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার জাফরাবাদ এলাকায় একই পরিবারের ছয় সদস্যকে কুপিয়ে আলোচনায় আসে পাটালি গ্রুপ। ভুক্তভোগী পরিবারটি ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদের স্বজন বলে জানিয়েছিল তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে পাটালি গ্রুপের প্রধান হাসান ওরফে পাটালি হাসানসহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট বসিলা সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয় মুন্না। সে সময়ে পাটালি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এমনকি পাটালি গ্রুপের অস্ত্রের বিষয়ে নানা তথ্য সেনাবাহিনীকে দেয় মুন্না। সেই তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক অভিযান চালানোর কথা সেনা ক্যাম্পের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
পরবর্তীতে মুন্নাকে মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী। থানা পুলিশ মুন্নার বিরুদ্ধে থাকা একটি মারামারির মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। কিন্তু সেই মামলায় মাত্র ৪ দিনেই জামিন পান মুন্না। ১৩ই আগস্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে ১৪ আগস্ট রাতেই বনানীর থ্রি সিক্সটি শিসা লাউঞ্জে তিনি এ ঘটনা ঘটান মুন্না। এরপর কুমিল্লার বড়ুরা থানা এলাকায় রাব্বী হত্যার আরেক আসামি হামজার বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করেন। সেখানে অভিযান চালিয়ে মুন্না ও হামজাকে গ্রেফতার করে র্যাব-১ ও র্যাব-১১।
ঘটনার বিষয়ে জানতে থ্রি সিক্সটি শিসা লাউঞ্জের মালিক ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে মুন্না ও তার গ্যাং যে বনানী এলাকায় পরিচিত সেই তথ্য পাওয়া গেল নিহত রাব্বীর স্বজনদের কথায়।
রাব্বীর চাচাতো ভাই আল আমিন বলেন, রাব্বী হত্যায় জড়িত মুন্না ও হামজা বনানী এলাকায় পরিচিত। তবে আমরা পারিবারিকভাবে তাকে চিনি না। বাসায় কখনো আসতে দেখিনি।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রাব্বীর বন্ধুদের অনেকেই মুন্নাকে শনাক্ত করে। পরে তাদের কাছ থেকে মুন্নার ছবি ও মোবাইল নাম্বার নিয়ে আমরা থানা পুলিশকে দেই। এই ঘটনার পর নিহত রাব্বীর বাবা রবিউল আওয়াল বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় মুন্নাকে প্রধান আসামি ও থ্রি সিক্সটি শিসা লাউঞ্জের মালিক ইব্রাহিমকে তিন নম্বর আসামি করা হয়।
মোহাম্মদপুর থানায় মুন্নার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বাদী মো. আমির। এই ব্যবসায়ীকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ রাতে ডেকে নিয়ে হামলা চালান মুন্নাসহ বেশ কয়েকজন।
হামলার বিষয়ে আমির বলেন, আমি আমজাদ নামের একজনের কাছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু তিনি আমাকে টাকা দিচ্ছিলেন না। পরে এই ঘটনায় আমি মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। কিন্তু আমজাদকে পুলিশ ডাকলে সে পুলিশকে জানায়, সে উল্টো আমার কাছে ৩৫ লাখ টাকা পায়। কিন্তু পুলিশ প্রমাণ দেখাতে বললে সে জাল দলিল দেখায়। বিষয়টি পুলিশ ধরে ফেলায় তখন সে আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেয়। তখন তার বিরুদ্ধে মামলা করিনি। পরবর্তীতে সে বাকি তিন লাখ টাকা দেওয়ার তারিখ দেয়। টাকা দেওয়ার তারিখের দিন আমাকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার এলাকায় ডেকে নেয়। কিন্তু আমাকে টাকা না দিয়ে মারধর করা হয়।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে আমি জানতে পারি আমার পাওনা ৩ লাখ টাকা না দিয়ে আমজাদ মুন্নাসহ স্থানীয় একটি গ্রুপকে ৫০ হাজার টাকায় আমাকে হত্যার চুক্তি করে। সেই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল স্থানীয় বিএনপি পরিচয় দেওয়া জসিম নামের এক ব্যক্তি। তার সঙ্গে এই মুন্নাও ছিল। হামলাকারীর থাপ্পড়ে আমার বাম কান নষ্ট হয়ে গেছে। এই কানে কিছুই শুনি না। আমি এখনো চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে।
এদিকে বড় সন্তানকে হারিয়ে শয্যাশায়ী রাব্বীর বাবা রবিউল আওয়াল। হাঁপানি ও লিভারের রোগে ভুগছেন তিনি। ছেলের লাশ দেখে একাধিকবার জ্ঞান হারিয়েছেন। নিহত রাব্বী চার বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। তার স্ত্রী নোয়াখালীর একটি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্ত্রীকে নিয়ে এখনো ভালোভাবে সংসার জীবন শুরুর আগেই নৃশংস হামলায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে।